'সাপ কামড়ালে ওঝা নয়, ডাক্তারের কাছে যান'

ত্রিপুরার ‘খানদানি আয়ুর্বেদিক শাহি দাওয়াখানা’সহ আরও কয়েকটি সনদ দেখিয়ে নিজেকে সাপুড়ের পাশাপাশি দক্ষ কবিরাজ বলে দাবি করেন মো. খোকন। ছবি: প্রথম আলো
ত্রিপুরার ‘খানদানি আয়ুর্বেদিক শাহি দাওয়াখানা’সহ আরও কয়েকটি সনদ দেখিয়ে নিজেকে সাপুড়ের পাশাপাশি দক্ষ কবিরাজ বলে দাবি করেন মো. খোকন। ছবি: প্রথম আলো

২৭ বছর ধরে তিনি সাপের খেলা দেখান। বিষধর সাপ দড়ির মতো হাতে পেঁচিয়ে দর্শকদের বাহবা কুড়ান। ‘ঝাড়ফুঁকও’ কম জানেন না। কাউকে সাপে কাটলে ডাক পড়ে। ঝাড়ফুঁক বিদ্যা কাজে লাগান। দেখা গেছে, সাপের ছোবল খাওয়া ব্যক্তিরা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেছেন।

দেশ-বিদেশ থেকে কবিরাজি জ্ঞানে পারদর্শিতার সনদও রয়েছে তাঁর। কিন্তু নিজে যখন সাপের ছোবল খেলেন, তখন আর কোনো মন্ত্রেই কাজ হলো না। সাপুড়ে মো. খোকন এখন বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করছেন, ওঝা নয়, সাপের বিষ থেকে রক্ষা পেতে চিকিৎসকই ভরসা।

খোকনের ভাষায়, কপালের দোষে এমন হয়েছে। পীর-মুরশিদ আর ছেলেমেয়ের দোয়ায় প্রাণে বেঁচে গেছেন। তিনি বলেন, ‘সবার প্রতি আমার অনুরোধ, সাপ কামড়ালে ওঝা নয়, ডাক্তারের কাছে যান।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন, প্লাস্টিক অ্যান্ড রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারি বিভাগের ব্লু ইউনিটে পুরুষ ওয়ার্ডে (৩ নম্বর) গিয়ে কথা হয় মো. খোকনের (৪৫) সঙ্গে। সাপের কামড়ে তাঁর ডান হাতে পচন ধরেছে। দুই দফা অস্ত্রোপচারের পর হাত পেটের সঙ্গে ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে। পেশায় তিনি সাপুড়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে সাপের খেলা দেখান। তবে কয়েক বছর ধরে তাঁর মূল ব্যবসা সাপ কেনাবেচা। রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও ভোলা থেকে পাইকারি দরে সাপ কিনে তা বিক্রি করেন।

সাপের ছোবল খাওয়ার বিষয়ে খোকন বলেন, গত ২৭ মে রাজশাহীর আবদুলপুর থেকে ১০টি সাপ ডেলিভারি আসে তাঁর কাছে। এর মধ্যে আটটি দাঁড়াশ ও দুটি গোখরা ছিল। বাক্স থেকে একের পর এক সাপ হাত দিয়ে তুলছিলেন। ওই সময় গোখরা সাপ তাঁর ডান হাতের মাঝের আঙুলের উপরিভাগে কামড় দেয়।

বিষধর গোখরার কামড় খেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাপুড়ে খোকন। ছবি: প্রথম আলো
বিষধর গোখরার কামড় খেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাপুড়ে খোকন। ছবি: প্রথম আলো

খোকনের ভাষায়, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারেন, এই বিষ ভয়াবহ। সঙ্গের লোকজনকে হাতের বাহুতে শক্ত করে কাপড় দিয়ে বাঁধতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা নিয়ে টঙ্গী স্টেশন রোডে আসেন, সেখান থেকে আরেকটি অটোরিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে চলে আসেন। তিনি জানান, হাসপাতালে সাপের বিষনাশক অ্যান্টি ভেনম বিনা মূল্যে দেওয়ার কথা অথচ তাঁকে ১০টি ইনজেকশন ১১ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে।

এভাবে বাক্স থেকে সাপ বের করলেন, ভয় লাগল না? এমন প্রশ্নে যেন হতবাক খোকন। বিস্ময় নিয়ে বললেন, ‘ভয় পাব ক্যান? সাপরে তো রশির মতো মনে হয় আমার কাছে।’

হাসপাতালে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপে সাপুড়ে জীবন নিয়ে সুখ-দুঃখ ও স্বপ্নের কথা জানান খোকন। বংশপরম্পরায় তাঁরা সাপুড়ে। তাঁর ভাষায়, মায়ের পেটে ‘সাপের ঘ্রাণ নিয়ে বড় হয়েছেন’। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা-মায়ের সঙ্গে নৌকায় ছিল তাঁর বসবাস। পরে সমতলে ভাড়া থাকা শুরু করেন।

২০০৭ সালে গাজীপুরে সদর উপজেলার পুবাইল ইউনিয়নে খোরাইদ গ্রামে দুই কাঠা জমির ওপর দুই কামরার একটি ঘর বানিয়েছেন। স্ত্রী, পাঁচ মেয়ে আর যমজ দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন সাপুড়ে পরিবারের সঙ্গে। ১১ বছর বয়সী যমজ ছেলেদের ভিন্ন পেশায় দেওয়ার স্বপ্ন থেকে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন। সাপের খেলার চেয়ে সাপ কেনাবেচায় লাভ বেশি হওয়ায় কয়েক বছর ধরে এ ব্যবসায় ঝুঁকেছেন বলে জানালেন।

কেমন বেচাকেনা হয়? বললেন, প্রজাতিভেদে সাপের দাম কমবেশি হয়। তাঁর ভাষায়, সাপের দাম ‘মাছের মতো’ ওঠানামা করে। কেউটে ও গোখরা সাপ ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় কিনে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করেন। ‘সুতা নলী’ নামের চিকন এক সাপ আছে, সেগুলোর দাম আড়াই হাজার টাকা। প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ে হেলে সাপ। কিন্তু সেগুলোর ‘এক পয়সারও’ দাম নেই। সাপ বেচাকেনা থেকে মাসে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয় তাঁর।

সাপ নিয়ে আলোচনায় রীতিমতো নড়েচড়ে বসেন খোকন। তাঁর আগ্রহ থেকে বোঝা যাচ্ছিল, আলোচনার জন্য এটা তাঁর পছন্দের ইস্যু। এক হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে একটি কালো ব্যাগ থেকে বের করেন সাপসংক্রান্ত এক বই। বইয়ের নাম ‘সাপের অজানা কথা’। লেখকের নাম এইচ এম হোসেন। বইয়ের পাতা উল্টে একেক রকমের সাপের ছবি দেখিয়ে নাম বলতে শুরু করেন। বইটিতে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাপের সঙ্গে ছবি ছাপা হয়েছে। বইয়ে সাপ হাতে ধরে থাকা এক শিশুর ছবি দেখিয়ে জানালেন এটা তাঁর ভাগনে। সাপ নিয়ে খেলা দেখানো এক নারীর ছবি দেখিয়ে জানালেন, এটা তাঁর বোন ‘পারুল বেদেনী’।

বইয়ের কোন অংশে কী আছে, তা যেভাবে দেখাচ্ছিলেন, এতে মনে হচ্ছিল, তিনি পড়ালেখা জানেন। কত দূর পড়েছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘পড়ালেখা করিনি।’ তাহলে কীভাবে বইয়ের লেখা দেখাচ্ছেন? বললেন, তাঁর ‘আউট নলেজ’ থেকে জানেন কোথায় কী লেখা আছে।

খোকনের কাছ থেকেই জানা গেল, গেছোবোড়া, চন্দ্রবোড়া, গোখরা বা কোবরা, কেউটে সাপ ভয়াবহ বিষধর। আর গাঙ কেরেলি সাপ (মাইট্টা সাপ) পুকুর, ডোবার পানিতে থাকে। কেউ মাছ ধরতে গেলে হরহামেশাই কামড় দেয়। তবে সেগুলোয় কোনো বিষ নেই। বেত আছড়া নামে আরেক ধরনের সাপ আছে, সেটাতেও বিষ নেই। খোকন জানালেন, দীর্ঘ সাপুড়ে জীবনে এবারটা নিয়ে দুবার সাপের কামড় খেয়েছেন। ছয় বছর আগে প্রথম তিনি সাপের কামড় খান। তবে সেই সময় কোনো সমস্যা হয়নি।

বইয়ের পাতায় সাপ হাতে মো. খোকনের ভাগনের ছবি। ছবি: প্রথম আলো
বইয়ের পাতায় সাপ হাতে মো. খোকনের ভাগনের ছবি। ছবি: প্রথম আলো

কালো ব্যাগ থেকে বেশ কয়েকটি সনদ বের করে দেখিয়ে খোকন বললেন, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কবিরাজির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এই সনদগুলো পেয়েছেন। এর মধ্যে একটি ত্রিপুরার ‘খানদানি আয়ুর্বেদিক শাহি দাওয়াখানা’র ১৯৯৫-৯৬ সালের দুই বছরের প্রশিক্ষণের সনদ রয়েছে। এই শিক্ষা নিয়ে তিনি তাবিজ দেন, ঝাড়ফুঁক করেন।

কাকে তাবিজ দেন, কাজ হয়? বললেন, অবশ্যই হয়। অনেক বাচ্চা বড় হয়েও বিছানায় প্রস্রাব করে, তাদের তাবিজেই কাজ হয়। বাতের ব্যথাও তাবিজে নিরাময় হয়।

বই, সনদ সব সময় সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন কি না, জানতে চাইলে বিমর্ষ স্বরে সাপুড়ে খোকন বলেন, ‘সব সময় ঘুরি না। হাসপাতালে আসার সময় নিয়া আসছিলাম। ভাবছিলাম, সাপুড়ে দেখে ডাক্তাররা যত্ন নিয়া ফ্রি চিকিৎসা করবে।’

কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন খোকন। বলেন, অনেক স্বপ্ন ছিল। সেসব আর কখনো পূরণ হবে না। এখন পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা চিকিৎসায় খরচ হয়েছে। ধারদেনা করে জমানো টাকা দিয়ে চলছে চিকিৎসা।

স্বপ্নটা কী ছিল? জিজ্ঞেস করলে কোনো জবাব দেননি খোকন। গামছার কোনা দিয়ে চোখের পানি মুছে যাচ্ছিলেন শুধু।

চিকিৎসক যা বললেন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রোবেদ আমিন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে প্রথমবার চিকিৎসা দেওয়ার পর খোকন জোর করে বাড়ি চলে যান। তাঁর হাতের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ডান হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত পানি-ফোসকা পড়ে। সেগুলো ফেটে যায় এবং হাতে পচন ধরে। এরপর তাঁকে মেডিসিন বিভাগ থেকে বার্ন, প্লাস্টিক ও রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাঁর ‘স্কিন ড্রাফটিং’ হয়। পায়ের ঊরু থেকে চামড়া নিয়ে হাতে লাগানো হয়। সেই অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। কয়েক দিন আগে তাঁর আরেক দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ পর হাতের পরিস্থিতি বোঝা যাবে।

রোবেদ আমিন বলেন, খোকনের হাতের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে মনে হচ্ছিল হাতটি কেটে বাদ দিতে হতে পারে। তাঁর হাতে বোধ আছে, আঙুল নড়াচড়া করতে পারেন। এতে ধারণা করা যাচ্ছে, হাতটি এ যাত্রায় রক্ষা পেতে পারে। তবে ধৈর্য ধরে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হবে।

সাপের কামড়ের ওপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থিসিস করেছেন রোবেদ আমিন। এ ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, সাপের কামড়ের রোগীদের ক্ষেত্রে একটা প্রবণতা দেখা যায়, সাপ কামড় দেওয়ার পরপর তাঁদের হাত বা পা শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়। অনেকে এতই শক্ত করে বাঁধেন যে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে কারও কারও গ্যাংগ্রিনও হয়ে যায়। এত শক্ত করে বাঁধার কোনো প্রয়োজন নেই। কামড় খাওয়া হাত বা পা যেন নড়াচড়া করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখলেই হবে। সে ক্ষেত্রে সতর্কতা হিসেবে হাত বা পায়ের দুই পাশে কাঠের টুকরো দিয়ে কাপড় দিয়ে আলতো করে বেঁধে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে।

চিকিৎসক জানান, দেশে ৮২ প্রজাতির সাপ রয়েছে। কারও কারও মতে, সাপের প্রজাতির সংখ্যা ১০০। এর মধ্যে ছয় ধরনের সাপ বিষধর। বাকি সাপগুলো কামড় দিলেও কিছু হয় না। এই সুযোগটাই নেন ওঝারা। আমাদের দেশে সাপের কামড়ের রোগীদের স্বজনেরা চিকিৎসকের কাছে না এনে ওঝার কাছে নেন। বিষধর সাপ না হলে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ওই রোগীরা সুস্থ হয়ে যান। আর স্বজনেরা ভাবেন, ওঝার ঝাড়ফুঁকে ভালো হয়ে গেছে।

রোবেদ আমিন বলেন, বিপদটা তখনই হয়, যখন বিষধর সাপ কামড়ায়। ওঝার কাছে নেওয়ার কারণে সময় নষ্ট হয়। পরে চিকিৎসকের কাছে আনা হলেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।

দেশে সাপের কাপড়ের ওপর সাম্প্রতিক কোনো সরকারি গবেষণা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রিদওয়ানুর রহমান, এম আবুল ফয়েজ, শাহজাদা সেলিম, বায়েজিদুর রহমান, আরিফুল বাশার, মোয়াজ্জেম হোসেন, জিয়াউল ইসলাম, হাবিব আহমেদ, আবুল হাসনাত মিলটন এবং অস্ট্রেলিয়ার অ্যালিসন জোনস ও ক্যাথেরিন ডি’এস্তে—দেশি-বিদেশি একদল চিকিৎসক ২০১০ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে সাপের কামড়ের ওপর এক গবেষণা করেন। এতেও দেশের পুরো চিত্র উঠে আসেনি। ওই গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে বছরে গড়ে এক লাখ মানুষের মধ্যে ৬২৩ দশমিক ৪ জন সাপের কামড়ের শিকার হয়।

সাপের কামড়ের ওপর দেশে ২০১৬ সালে প্রকাশিত পৃথক এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে প্রতিবছর গড়ে এক লাখ মানুষের মধ্যে ১০ দশমিক ৯৮ জন মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। আর মারা যায় এক লাখে ১ দশমিক ২২ জন। বছরে গড়ে ১৫ হাজার ৩৭২টি সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মারা যায় ১ হাজার ৭০৯ জন। ‘স্নেক বাইট এপিডেমিওলজি ইন বাংলাদেশ—‘এ ন্যাশনাল কমিউনিটি বেজড হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণাটি যৌথভাবে করেছিল সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ও সুইডেনের ওরেব্রো ইউনিভার্সিটি।