'সিআইডি কয়, ধৈর্য ধরতাম, আশা রাখতাম'

আনোয়ারা বেগম। ফাইল ছবি
আনোয়ারা বেগম। ফাইল ছবি

বছরজুড়ে আলোচিত ঘটনার মধ্যে ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর মৃত্যু। তাঁর লাশ গত ২০ মার্চ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরে কালভার্টের ২০ থেকে ৩০ গজ পশ্চিমে ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয়। দীর্ঘ সময়ে এ মামলার কোনো কিনারা করতে পারেনি সিআইডি। এসব বিষয় নিয়ে তনুর মা আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে ২৬ ডিসেম্বর কথা বলেছেন গাজীউল হক

প্রথম আলো : অনেক দিন পর আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে, কেমন আছেন?
আনোয়ারা বেগম : বাজান, আমরা কিয়ের ভালা আছি। নয় মাস যাইতেছে, তনু নাই। তার ওপর ওর দাদা অসুস্থ। দম যায় আর আসে। কিছু খায় না। তনুর লগে আমার শ্বশুরের ভালা খাতির ছিল। কুমিল্লা থেকে মুরাদনগরের বাড়িতে গেলে দাদার গলা জড়িয়ে থাকত ও। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর দাদাও ভাইঙ্গা পড়েন। আমাদের আর ভালা থাকা। যেখানে আমরা থাকি (কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতরের আবাসিক কোয়ার্টার), সেখানেও আমাদের চোখে চোখে রাখা হয়। কই যাই, কার কাছে যাই, এখনো খোঁজ নেওয়া হয়। চাকরির কারণে এখানে আছি, কোনো রকমে থাকা আর কি?

প্রথম আলো : তনু হত্যাকাণ্ডের নয় মাস পেরিয়ে গেল। এ মামলার অগ্রগতি কী?
আনোয়ারা বেগম : এ মামলার কোনো অগ্রগতি দেখছি না। এখন পর্যন্ত একজন আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। আসামি শনাক্তও হয়নি। মামলার চার্জশিটও (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়নি। মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি ৩ ডিসেম্বর আমাদের ঢাকায় ডেকে নেয়। সেখানে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মামলা নিয়ে সিআইডি কয়, ধৈর্য ধরতাম, আশা রাখতাম। আমারে কয়, আপনি বেশি কথা বলেন। মেয়ে মারা গেছে আমার, কথা তো আমারেই কইতে অইব। মামলা নিয়ে সিআইডির ৩ তারিখের পর আর কোনো তৎপরতা দেহি না।

প্রথম আলো : আপনারা যাদের সঙ্গে ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য বলেছিলেন, তা কি করা হয়েছে?

আনোয়ারা বেগম : এটা আমরা বলতে পারব না। সিআইডি কয়, আমরা খাড়াত আছি। ধৈর্য ধরেন। যাদের সঙ্গে ডিএনএ মেলানো দরকার, তাদের সঙ্গে মেলায় না কেরে। আমি এ মামলার কোনো কিনারা দেখছি না। হতাশ আমরা।


প্রথম আলো : আপনার মেয়ে তো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। যতটুকু জেনেছি, গত বছর বিজয় দিবসেও নাচগান করেছে। লাল-সবুজ শাড়ি পরেছে। এবারের বিজয় দিবসে কি সেটা মনে পড়ে?
আনোয়ারা বেগম : ছোটবেলা থেকে আমার মেয়ে নাচগান ও চিত্রাঙ্কনে ভালো ছিল। যেকোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বহু পুরস্কার পেয়েছে। নানান দিবসের সঙ্গে মিল রেখে পোশাক পরত। ১৬ ডিসেম্বর ওর কথা বেশি মনে পড়েছিল। আসলে প্রতিদিনই মেয়েটার মুখটা ভেসে ওঠে। ঘর ফাঁকা থাকলেই ওর কথা মনে পড়ে।


প্রথম আলো : এখন আপনাদের দিন কাটছে কেমন?
আনোয়ারা বেগম : কষ্টে দিন যাচ্ছে। মনে কোনো শান্তি নাই। আল্লাহর কাছে মেয়ে হত্যার বিচার দিচ্ছি। ফেরাউনের মতো কোনো কিছু ঘটলে মনটা শান্তি পাইত। ২৩ ডিসেম্বর রাতে মেয়ের জন্য গ্রামের বাড়ি মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুরে দোয়া পড়াইছি।


প্রথম আলো : বিচার পাইবেন বলে কি মনে হয়?
আনোয়ারা বেগম : কইছি তো, কেউ বিচার না করলে আল্লাহ একদিন না একদিন করব। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে দেখা করতে চাই। তদন্ত সংস্থা খালি জিজ্ঞাসাবাদ আর আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছে।


প্রথম আলো : মেয়ের সঙ্গে বিশেষ কোনো স্মৃতি কি আপনাকে বারবার তাড়া করে?
আনোয়ারা বেগম : প্রতিদিনই মেয়ের কথা মনে পড়ে। মেয়েটা যে আমার কী আছিল, বলে বোঝানো যাবে না। পরিবারের তিন সন্তানের মধ্যে তনু সবার ছোট ছিল। ছোট মেয়ে হিসেবে ওরে সবাই আদর করত। কলিজার টুকরা ছিল, মেয়ে আমার। সেই মেয়ে নাই, এটা মনে এলে মাথা ঘোরে। গত নয় মাসে চোখের জলে মেয়েকে স্মরণ করি। রাইতে কান্দি, দিনে কান্দি। আমার গেছে আমিই জানি। মেয়েটি আমার সবকিছু ছিল। এখন কারে নিয়ে বাঁচব? তারপরও আছি।


প্রথম আলো : তনু হত্যার প্রতিবাদে দেশ-বিদেশে আন্দোলন হয়েছে। পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে নানা খবর উঠেছে। এখন আন্দোলনের কী অবস্থা?
আনোয়ারা বেগম : মেয়ের বিচারের জন্য যাঁরা মাঠে আন্দোলন করেছেন, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল ভূমিকা রেখেছেন, তা কোনো দিন ভুলব না। দেশবাসী আমার মেয়ের জন্য অনেক কিছু করেছে। আমার মেয়ে পড়াশোনা করে নাম কামাতে চেয়েছিল। উল্টা মৃত্যুই তাকে পরিচিত করেছে। আমি নিজে কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে দুইবার, পৌর পার্কে একবার ও সিআইডি কার্যালয়ে গিয়েও মেয়ে হত্যার বিচার চেয়েছি। এখনো অনেকে সান্ত্বনা দেন। আন্দোলন মাঝেমধ্যে হয়। পুলিশ কাজ করলে সবই সম্ভব।


প্রথম আলো : এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আনোয়ারা বেগম : প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ, সব সময় আমাদের সহযোগিতা করার জন্য।