মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে সন্তান থাকবে কার কাছে

প্রতীকী ছবি

কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ বা তালাক হলে তাঁদের যদি সন্তান থাকে, সেই সন্তানকে নিজের কাছে রাখা নিয়ে মা-বাবার মধ্যে যেন রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মা-বাবা যদি আপস-মীমাংসায় বিষয়টি সুরাহা না করতে পারেন, তাহলে আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে বিষয়টি। তখন মা-বাবার পাশাপাশি সন্তানের জীবনও হয়ে পড়ে দুর্বিষহ।

বিচ্ছেদের পরে মা-বাবার কে কতটা পান সন্তানের অধিকার? সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও মায়া থেকে মা-বাবা—দুপক্ষই চায় সন্তানের একচ্ছত্র অধিকার। সন্তানের প্রতি উভয়েরই অধিকার আছে। কিন্তু আইন কী বলে এ নিয়ে? কীভাবে তা আদায় করতে হয়?

কে অভিভাবক, কে তত্ত্বাবধায়ক

মুসলিম আইন অনুযায়ী বাবা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক আর মা হচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক। সন্তানের মা যদি বাবার কাছ থেকে আলাদা থাকেন কিংবা তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তাহলে মা তাঁর সন্তানের তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা হারাবেন না। ছেলের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়েসন্তানের বয়ঃসন্ধি বয়স পর্যন্ত মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। সন্তানের ভালোর জন্য যদি তাকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখার আরও বেশি সময় প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এ বয়সসীমার পরও মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। তবে এ জন্য ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে। মা যদি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাহলে সন্তানকে নিজের হেফাজতে রাখার ক্ষমতা হারাতে পারেন। তবে সন্তানের সার্বিক কল্যাণই বড় কথা এবং বিষয়টি আদালতে গড়ালে আদালত সন্তানের সার্বিক মঙ্গলের কথা আগে বিবেচনা করেন এবং সন্তানের মঙ্গলের জন্য যেকোনো ন্যায়ানুগ আদেশ দিতে পারেন। উচ্চ আদালতের অনেক রায়ও আছে এ নিয়ে।

সন্তানের সঙ্গে দেখা করা

বাবা–মায়ের বিচ্ছেদ সন্তানের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে
ছবি: প্রথম আলোর তোলা ছবিটি প্রতীকী

আইন অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও সন্তানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। বিচ্ছেদের পর সন্তান যাঁর কাছেই থাকুক না কেন, মা বা বাবার সমান অধিকার রয়েছে সন্তানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার। এমন যদি হয়, তালাকের পর কোনো পক্ষ সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না, তাহলে একমাত্র উপায় হচ্ছে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নেওয়া। পারিবারিক আদালত তখন আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন সন্তান কার কাছে থাকবে। আদালতের ক্ষমতা রয়েছে সন্তানের কল্যাণের দিকটি বিবেচনা করার। আদালত সন্তানের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের দিকটি বিবেচনা করে বাবা বা মা, যে কারও কাছে রাখার জন্য আদেশ দিতে পারেন। অনেক সময় সন্তানের যদি ভালো-মন্দ বোঝার মতো সক্ষমতা থাকে, তাহলে সন্তানের মতামতকেও আদালত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। পারিবারিক আদালতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে কাছে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।

সন্তান যার হেফাজতেই থাকুক, মা-বাবা দুজনের সান্নিধ্যই যেন পায়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে
প্রথম আলোর তোলা ছবিটি প্রতীকী

পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ১৬ক ধারায় আদালতের কাছে সন্তানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার জন্য আবেদন করা যায়। তবে এ ধারায় সরাসরি আবেদন করা যাবে না। প্রথমে পারিবারিক আদালতে সন্তানের হেফাজত কিংবা অভিভাবক হওয়া নিয়ে একটি মোকদ্দমা করে নিতে হবে। মূল মোকদ্দমার সঙ্গে এ আবেদন করতে হবে। এ আবেদন বাদী বা বিবাদী, যে কেউ করতে পারেন। সাধারণত এ ধরনের আবেদন করা হলে আদালত শুনানি শেষে অপর পক্ষকে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে দুপক্ষের বক্তব্য শুনে সন্তানের দেখাশোনা করার অনুমতি দিতে পারেন। তবে আদালত এ ক্ষেত্রে সন্তানের মঙ্গলের বিষয়টি সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়ে থাকন। আদালত তখন প্রয়োজন মনে করলে সন্তানের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে কোনো পক্ষকে সময় বেঁধে দিতে পারেন। কোনো কারণে আদালতের আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে জেলা জজ আদালতে এবং জেলা জজের আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় সন্তানকে খোঁজ করতে হাইকোর্টে সরাসরি রিট দায়েরের সুযোগও রয়েছে।

সন্তানের ভরণপোষণ

স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদে সন্তান কার কাছে থাকবে, তা আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন
প্রথম আলোর তোলা ছবিটি প্রতীকী

বিচ্ছেদের পর সন্তান যদি মায়ের কাছে থাকে, অনেক বাবা মনে করেন, সন্তানের ভরণপোষণ দিতে হবে না। এটা ঠিক নয়। সন্তান বাবা কিংবা মা, যাঁর কাছেই থাকুক না কেন, তার ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বাবার। অর্থাৎ মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলে কিংবা মা-বাবা আলাদা বসবাস করলে বাবাকেই সন্তানের ভরণপোষণ প্রদান করে যেতে হবে। বিচ্ছেদ হোক বা না হোক, ইচ্ছা করলে মা আলাদা থেকেও সন্তানের ভরণপোষণ আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।

তানজিম আল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী