বিপুল সংগ্রহ ব্যবহার করতে পারবেন সাংবাদিক ও গবেষকেরা

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন ও মতবিনিময় সভায় সাংবাদিক ও দর্শনার্থীরা। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেছবি: প্রথম আলো

জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রাপ্তি। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বেশি প্রামাণ্য নিদর্শন সংগৃহীত রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। সাংবাদিক ও গবেষকেরা তাঁদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বা গবেষণার প্রয়োজনে এসব নিদর্শন ও তথ্য–উপাত্ত ব্যবহার করতে পারবেন।

বুধবার সকালে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও গবেষকদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন ও মতবিনিময় সভায় জাদুঘরের ট্রাস্টিরা এ বিষয়টি তুলে ধরেন। প্রথমেই সাংবাদিকদের জাদুঘরের গ্যালারিগুলো পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর জাদুঘরের পাঠাগার ও আর্কাইভে সংরক্ষিত নিদর্শন ও তথ্য-উপাত্তের বিষয়ে জানানো হয়।

জাদুঘরের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় দুটি করে চারটি গ্যালারিতে দর্শনার্থীদের জন্য নিদর্শন প্রদর্শন করা হচ্ছে। প্রথম গ্যালারির নাম ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগের সমন্বিত সংস্কৃতি’। এখানে প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যসহ বিভিন্ন নিদর্শন রাখা হয়েছে। ‘আমাদের অধিকার, আমাদের ত্যাগ’ নামের দ্বিতীয় গ্যালারিতে আছে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ঘটনাবলির নিদর্শন। তৃতীয় গ্যালারির নাম ‘জয় বাংলার যাত্রা’। এতে আছে এপ্রিলের পরের ঘটনাবলি। শরণার্থী, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, রণাঙ্গনে যুদ্ধ ইত্যাদি। শেষ গ্যালারির নাম ‘আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ’। এতে আছে সর্বাত্মক যুদ্ধ, নারী নির্যাতন, বুদ্ধিজীবী হত্যা, বিদেশে প্রচার এবং চূড়ান্ত বিজয়।

গ্যালারি পরিদর্শনের পরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম, গবেষণা ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপক রেজিনা বেগম, আর্কাইভের কিউরেটর আমেনা খাতুন, শিক্ষা ও প্রকাশনা ব্যবস্থাপক সত্যজিৎ রায় জাদুঘরের সংগ্রহ সম্পর্কে জানান। পাঠাগারে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। এসব বই বিষয় ভিত্তিতে সাজানো রয়েছে।

পাঠাগারে আছে ১৯৭১ সালে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিপুল পরিমাণ কাটিং। শরণার্থীদের নিয়ে চার খণ্ডে ইউএনএইচসিআরের দলিলপত্র। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে মার্কিন কূটনীতিকেরা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যেসব বার্তা আদান–প্রদান করেছিলেন তা আছে তিন খণ্ডে। ব্রিটিশ কূটনীতিকদের অনুরূপ বার্তা আছে ৫০ খণ্ডে। রাজাকার ও দালাল সম্পর্কে সরকারি গেজেটের ৬ খণ্ড, পাকিস্তানের ডেইলি ডন এবং পাকিস্তান টাইমস পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা ৪৯ হাজার ২৩৯ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর নাম–পদবি প্রভৃতি। বিভিন্ন ব্যক্তির দেওয়া আরও অনেক মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে পাঠাগারে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখছেন এক দর্শনার্থী। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে
ছবি: প্রথম আলো

এর পাশাপাশি আছে আরেক প্রকার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য যাঁরা ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাঁদের একটি নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করতে হতো। এই ফরমে মুক্তিযোদ্ধার নাম, বয়স, ঠিকানা, প্রশিক্ষণের তারিখ, প্রশিক্ষণের তথ্য এবং কী ধরনের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছেন ইত্যাদি তথ্য রয়েছে। এমন ৫১ হাজার ৫০০ ফরম সংগ্রহে রয়েছে। এগুলো ২০৮টি খণ্ডে সংকলিত করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধারই বয়স ৩০ বছরের কম।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আর্কাইভে রয়েছে আলোকচিত্র, পত্রপত্রিকা, অনেক ধরনের দলিল, দেশ–বিদেশের বহু পোস্টার, লিফলেট, স্মরণিকাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনা, ব্যক্তিগত সামগ্রী।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেকটি বড় সংগ্রহ হলো মুক্তিযুদ্ধের মৌখিক ইতিহাস। জাদুঘরের পক্ষ থেকে আউটরিচ কর্মসূচিতে দেশের প্রতিটি জেলার মোট ৪৪৫টি উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর গিয়েছে। সেখানে স্কুলশিক্ষার্থীরা জাদুঘর দেখেছে। তারা নিজ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা বা প্রবীণ ব্যক্তি, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তাঁদের মুখ থেকে বিবরণ শুনে তা লিখে স্কুলশিক্ষকদের মাধ্যমে সত্যায়িত করে জাদুঘরে পাঠিয়েছে। এভাবে মোট ৫৫ হাজর ১৬৭টি মৌখিক ভাষ্য সংগৃহীত হয়েছে। পরে এগুলো যাচাই–বাছাই করে গ্রন্থ আকারে ৫২টি জেলার মৌখিক বিবরণ ১২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। অবশিষ্ট জেলার মৌখিক ভাষ্য মুদ্রণের কাজ চলছে। সব মিলিয়ে জাদুঘরের সংগৃহীত নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ নিদর্শন গ্যালারিতে সর্বসাধারণের জন্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। অবশিষ্ট নিদর্শন সুরক্ষিত রয়েছে।

পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, মফিদুল হক ও ত্রপা মজুমদার। তাঁরা বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছর বিজয়ের মাস ডিসেম্বর ও স্বাধীনতার মাস মার্চে দেশের পত্রপত্রিকাগুলো প্রথম পাতায় গুরুত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ, মানবিক প্রতিবেদন, ফিচার, ছবি প্রকাশ করে আসছে। তবে গত বছর ডিসেম্বরে এর অনেকটা ব্যতিক্রম দেখা গেছে। এ বছর আসন্ন বিজয়ের মাসে জনগণ, বিশেষত নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করতে গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধানী বা মানবিক আবেদনধর্মী প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে। তাদের সহায়তার জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিজেদের আর্কাইভ, পাঠাগার ও গ্যালারিতে থাকা নিদর্শনগুলো সংবাদকর্মী ও গবেষকদের জন্য ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছে। শুধু বিজয়ের মাসেই নয়, সাংবাদিক ও গবেষকেরা তাঁদের প্রয়োজনে সারা বছরই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এসব তথ্য–উপাত্ত ও নিদর্শন থেকে সহায়তা নিতে পারবেন।