প্রথম আলো প্রকাশের আগে আমাদেরও একটা ঐকমত্য সনদ তৈরি হয়েছিল। সেটা কাগজে কাগজে লেখা হয়নি। তা লেখা হয়েছিল হৃদয়ে হৃদয়ে, তাই আজও তা সতেজ, সজীব, সক্রিয় ও জীবন্ত রয়ে গেছে।
সে আজ থেকে ২৭ বছর আগের কথা। আমি তখন পক্বকেশ নই, এমনকি কাঁচাপাকা বাবুও নই। আমরা সবাই তরুণ। ভোরের কাগজে আমরা কাজ করি। আগে ছিলাম আজকের কাগজে। ভোরের কাগজ-এর ফিচার সম্পাদক হিসেবে আমাকে সম্পাদক মতি ভাই (মতিউর রহমান) দায়িত্ব দিয়েছিলেন নতুন কিছু করার। আমরা ‘মেলা’ নামের একটা সাপ্তাহিক ফিচার ক্রোড়পত্র করেছিলাম।
এরপর বললেন, শনিবারে সার্কুলেশন কমে। দেখো তো আরেকটা কিছু করা যায় কি না। আমরা অবসর নামের একটা ১৬ পাতার ম্যাগাজিন বের করতে শুরু করি। চিঠিপত্রে ‘পত্রকলাম’, ফোনে পাঠকদের মত সরাসরি নিয়ে জরিপ করা—নানা নতুন কিছু করার উন্মাদনায় তখন আমরা ভেসে যাচ্ছিলাম।
এ সময় ভোরের কাগজ-এর তৎকালীন প্রকাশক ১৯৯৬-এর নির্বাচনে সরকারদলীয় এমপি নির্বাচিত হলেন। আমাদের সম্পাদক দুর্ভাবনায় পড়লেন। বললেন, দলীয় এমপির কাগজ তো দলনিরপেক্ষ রাখা যাবে না। আমরা স্বাধীন কাগজ করব।
মাহ্ফুজ আনাম তখন ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক। তিনি মতি ভাইকে নিয়ে গেলেন লতিফুর রহমানের সকাশে। মতি ভাই আমাদের ডেকে বললেন, চলো, আমরা নতুন কিছু করি!
আমরা আজকের কাগজ থেকে এসেছি ভোরের কাগজ-এ। আবার একটা নতুন প্রতিষ্ঠানে যেতে হবে! সবার কাঁধ ঝুলে পড়ল, একসঙ্গে বলে উঠলাম—‘আবার!’
মতি ভাই বললেন, এই কাগজ হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। সম্পূর্ণ দলনিরপেক্ষ!
তখন সাজ্জাদ শরিফ, উৎপল শুভ্র, সুমনা শারমীন আর আমি—আমরা মতি ভাইকে প্রশ্ন করলাম, এই কাগজ কি মালিকের প্রভাব থেকেও মুক্ত থাকবে?
মতি ভাইয়ের জবাব, ‘হ্যাঁ। কাগজে কী ছাপা হবে না হবে, লতিফুর রহমান সাহেব তা জানতে চাইবেন না।’
[সত্যি সত্যি লতিফুর রহমান সাহেব কোনো দিনও জানতে চাননি, প্রথম আলোয় কী ছাপা হচ্ছে। প্রতিবছর ৪ নভেম্বরে প্রথম আলোয় বেড়াতে আসতেন। এসে বলতেন, আপনারা এ বছর দুই লাখ কপি ছাড়িয়েছেন, সামনের বছর তিন লাখ কপি যেন অতিক্রম করতে পারেন। আর বলতেন, আপনাদের সবার মনে কোনো না কোনো আদর্শের প্রতি সমর্থন আছে। কাউকে না কাউকে আপনারা ভোট দেন। কিন্তু কাগজে লেখার সময় আপনি নিরপেক্ষ। এটা মনে রাখবেন।’]
আমরা বললাম, ‘আপনার বন্ধুবান্ধব অনেকেই আছেন রাজনীতি করেন। তাঁদের সম্পর্কে লেখার সময় কি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবেন?’
মতি ভাই বললেন, ‘পারব। পারতেই হবে। সে জন্যই তো নতুন কাগজ।’
আমরা শুধালাম, ‘আমাদের যারা বিজ্ঞাপন দেবে, তাদের বিরুদ্ধেও কি নতুন কাগজে স্বাধীনভাবে লেখা যাবে?’
‘অবশ্যই যাবে। আমরা কারও বিরুদ্ধে বিদ্বেষপ্রসূত খবর করব না। কিন্তু যা সত্য, যা খবর, তা বিজ্ঞাপনদাতার বিরুদ্ধে গেলেও প্রকাশ করা হবে। করতে হবে।’
এটাই ছিল আমাদের ঐকমত্য সনদ। আমরা সবাই মনে মনে এটাতে স্বাক্ষর করেছি। আমরা বললাম, আমরা নতুন কাগজে যাব।
আমাদের কাগজটার প্রথম প্রস্তাবিত নাম কী ছিল, জানেন? দৈনিক একুশে। আমরা কাজ শুরু করেছি, এই সময় জানা গেল একুশে টেলিভিশন নামে নতুন টিভি আসছে। তখন আবার নাম বদলের পালা। কত কত নাম যে জমা পড়ল। সেই সময় আমরা জানতে পারলাম, দেশে কত বিচিত্র নামে সংবাদপত্র আছে। সেসব নাম পরিহার করতে হবে। শেষে এলে এই নাম—প্রথম আলো। আমাদের সবার একবারেই যে নামটা পছন্দ হয়েছিল, তা কিন্তু নয়।
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এর লোগো আঁকলেন। আলোর ওপরে একটা লাল সূর্য। সূর্যের রশ্মিগুলো আমার পছন্দ হয়নি। আমি বলি, রশ্মিগুলো না দিয়ে শুধু একটা লাল বৃত্ত দিলে হয় না। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য তখন ছিলেন আমাদের সঙ্গে, বললেন, না, রশ্মি থাকুক। লাল ডট তো কমন। কিন্তু রে দিলে সেটা আলাদা হয়ে যাবে।
তা-ই হলো। আজ আমাদের এই ৫ রশ্মি যেখানেই দেখি, সেখানেই বুঝি, এটা প্রথম আলো।
মতি ভাই যে পুরস্কারটা ২৭ বছরেও দেননি
মতি ভাই বলেছিলেন, আনিস, তোমার একটা পুরস্কার আছে। সেটা তিনি আজও আমাকে দেননি। কিংবা রোজই একটু একটু করে দেন। উৎসাহ দিয়ে, অনুপ্রেরণা জুগিয়ে, ভুল ধরিয়ে দিয়ে, সাহস দিয়ে, মাথা ঠান্ডা রেখে। বড় বিপদের সময়ও তিনি দেখি নিরুত্তেজিত থাকেন।
আরেকটা গুণ আমরা তাঁর কাছে থেকে শিখি, ঢিলের জবাবে ফুলের টোকাও না দেওয়া, পাটকেল ছোড়ার তো প্রশ্নই আসে না। আমাদের কেউ অপেশাদার আঘাত করলে আমরা গায়ে মাখি না। ওই আক্রমণের জবাব দেওয়ার জন্য সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করি না। আমাদের জবাব হলো, আরও সত্য। আরও পেশাদারত্ব। আরও সৃজনশীলতা। আরও বস্তুনিষ্ঠতা। আমরা আমাদের কাগজ বা অনলাইন বা কার্যক্রমগুলো আরও ভালোভাবে করব, ভালো কাজের মধ্য দিয়েই আমরা জবাব দেব। কাদা ছোড়াছুড়ি করে নয়।
আচ্ছা, ২৭ বছর তো হলো। পুরস্কারের কথাটা একটু স্মরণ করিয়ে দিই। ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর। পরের দিন বের হবে প্রথম আলো। অনেক পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্রসহ। প্রচার-প্রচারণা চলছে। আমরা শহরে শহরে গেছি বন্ধুসভার সহযোগিতায় এলাকার সুধীজনদের সঙ্গে পরামর্শসভা করতে।
হঠাৎ সন্ধ্যার সময় আমার মনে হলো, তখনকার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া প্রথম আলোর প্রকাশনা উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন। এটা বিটিভিতে পাঠিয়ে দিলে কী হয়। তখন কিন্তু একটাই টেলিভিশন—বিটিভি। মতি ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে বিটিভিতে প্রেস রিলিজ হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। রাত ১০টার ইংরেজি খবরে প্রচারিত হলো, আগামীকাল দেশে আসবে একটা নতুন দৈনিক। নাম প্রথম আলো। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছেন...
বিদ্যুদ্বেগে খবর ছড়িয়ে পড়ল। চাহিদা বাড়তে লাগল। প্রিন্ট অর্ডার বেড়ে হলো দ্বিগুণ।
মতি ভাই বললেন, তোমাকে একটা পুরস্কার দেওয়া হবে।
ওয়েল, আমরা প্রায় ৩৫ বছর ধরে একসঙ্গে আছি, এটাই আমার পুরস্কার।
অফিস ফাইলে চার লাখ টাকা
অ্যাসিডদগ্ধদের পাশে দাঁড়াতে হবে, এই আইডিয়া মতি ভাইয়ের। তিনি র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছিলেন ২০০৫ সালে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার প্রয়াসের স্বীকৃতি হিসেবে। পুরস্কার হিসেবে পান ৫০ হাজার ডলার, তখনকার হিসেবে ৩০ লাখ টাকা। পুরো টাকাটা তিনি প্রথম আলোর তিনটা সামাজিক কাজের জন্য দান করেন। ১. অ্যাসিডদগ্ধদের পাশে দাঁড়ানো। ২. মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ৩. দুস্থ সাংবাদিকদের কল্যাণ। ২০০৯ সালে প্রথম আলোর সামাজিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম আলো ট্রাস্ট। প্রথম আলোর বাইরের কেউ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এখন যেমন চেয়ারপারসন রূপালী চৌধুরী।
প্রথম আলো বন্ধুসভা প্রথম আলো প্রকাশেরও আগে গড়ে তোলা হয়েছিল। তারা প্রথম থেকেই বন্যায়-খরায়-মঙ্গায়-ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, বাড়িয়ে দিয়েছে সহমর্মিতার হাত।
স্কুলের বাচ্চারা তখন প্রথম আলোয় আসত, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে একটা তহবিল তারা গড়েছে, এটা প্রথম আলোর তহবিলে দেবে, বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য। আমার মনে আছে, একদিন এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বহু বছর আগের কথা। তখন বোধ হয় প্রথম আলোর বন্যার্তদের ত্রাণ দেওয়ার কর্মসূচি চলছিল। তাঁর হাতে একটা অফিস ফাইল। যেন তিনি চাকরির জন্য এসেছেন। আমাকে অফিসের নিচে ডেকে নিয়ে দেখা করলেন। আমার হাতে ফাইল তুলে দিলেন। বললেন, বন্যার্তদের জন্য আমার সামান্য অংশগ্রহণ। আমার নাম দিতে হবে না।
আমি অফিসে ঢুকে ফাইল খুলে দেখি, চার লাখ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে তহবিলের অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে দিলাম। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হয়নি। তিনি নিশ্চয়ই পরের দিনের কাগজে দেখেছেন, তহবিলের হিসাবে আছে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪ লাখ টাকা...
কত যে মর্মস্পর্শী ঘটনার সাক্ষী আমরা। লিখলে কাজ হয়, প্রথম আলোয় লিখলে আরও একটু বেশি কাজ হয়! পেন ইজ মাইটার দ্যান দ্য সোর্ড।
যে স্বপ্ন আমাদের সবার মাঝে ছড়িয়ে আছে
আমাদের জন্য প্রথম আলোর সম্পাদকের সারা দিনের রুটিন সম্পর্কে যদি বলতে থাকি, আপনারা কেউ বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। ভোরবেলা ওঠেন। সারা দিনের সব প্রস্তুতি সকাল সকাল সারা। এরপর বের হন। আহমদ রফিক অসুস্থ, তাঁর চিকিৎসার জন্য ল্যাবএইডকে বলতে হবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার হাসপাতালে, একটু দেখতে যেতে হবে। বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান কিংবা আনিসুজ্জামান স্যাররা যখন বেঁচে ছিলেন, তাঁদের বাসায় চলে যেতেন। একটু পরামর্শ নেওয়ার জন্য। এর মধ্যে হয়তো একজন ডিপ্লোম্যাট, একজন রাজনৈতিক নেতার বাড়ি ঘুরে এসেছেন।
ছাত্রজীবনে ক্রিকেট খেলেছেন, অলিম্পিকের রেকর্ড মুখস্থ, হয়তো একজন প্রবীণ খেলোয়াড়ের খোঁজ নিলেন। এরই মধ্যে ভাবলেন, জেমস কিংবা হানিফ সংকেত বা রুনা লায়লা-আলমগীর ভাইয়ের খোঁজ নেওয়া দরকার। নতুন পেইন্টিং জোগাড় করতে হবে। কিংবা পেইন্টারের বাড়ি যেতে হবে। দেশ-বিদেশের সেরা শিল্পীদের শিল্পকর্মের সংগ্রহ তাঁর যা আছে, ঢাকায় আর অল্প কমজনেরই তা আছে। নতুন বই এসেছে, এটা পড়ে দেখতে হবে।
সারাক্ষণ ইউটিউবে গান শুনছেন। জন লেনন থেকে দেবব্রত। জোন বায়েজের বিশেষ রকম ভক্ত তিনি। আবার প্রথমার নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপি পড়ে দিতে হবে, আর নতুন লেখকের অন্বেষায় চলে যেতে হবে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার বাসায়। মহিউদ্দিন আহমদ, আসিফ নজরুল, আলতাফ পারভেজের সঙ্গে এক বেলা খেতে হবে। এর মধ্যে পরের দিনের প্রথম আলোর প্রতিটা অক্ষর পড়ে দেবেন। বদলাবেন। নকশার ছবিতে কেন মুখের নিচে দাগ আসছে, বদলাও। এর মধ্যে এক বছর পর কী করতে হবে, তার পরিকল্পনা করছেন।
প্রথম আলো যে অনলাইনে যেতে হবে, সেটা তাঁরই ভাবনা ছিল ২৭ বছর আগেই। এটাকে যে আলাদা পোর্টাল করতে হবে, এটাও তাঁরই আইডিয়া। এর মধ্যে জিমে গেছেন, এর মধ্যে প্রবাসী লেখকের সঙ্গে ফোনে আলাপ সেরেছেন। তারপর দেখা গেল, আমাদের বিজ্ঞাপনের কর্মচারীর মেয়ের বিয়েতে হাজির, অফিস সহকারীর অসুখে হাসপাতালে চলে গেছেন নিজে। শহীদ নূর হোসেনের পরিবার কেমন আছে, কখন যেন দেখে এসেছেন।
স্মৃতিশক্তি ভয়াবহ। কর্মস্পৃহা অপরিসীম। পরিশ্রম করার ক্ষমতা বিস্ময়কর। এর মধ্যে বলবেন, আনিস, উপন্যাস কী লিখছ? কত দূর লিখতে পারলা? প্রেমের উপন্যাস লেখো একটা। আর ফাঁক দিয়ে কিশোরদের বইটা দিয়ে দাও। মেরিনা কী করছে। ফোন করব আজকে। পদ্য কবে আসবে। দেখা করতে যাব।
এই যে ব্যস্ততায় ভরা দিন, প্রথম আলোর সম্পাদক মানে রাজ্যের চাপ, প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা—সব সামলে এই আশ্চর্য মানুষটা এত ভারী ভারী গবেষণামূলক বইগুলো লিখলেন কখন? সর্বশেষ দুটি বই। ১. গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী: এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি। বাঙালি বিপ্লবী লুহানী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন, দেশে-বিদেশে গেছেন বিপ্লবের টানে, রাশিয়ায় গিয়ে শেষ পর্যন্ত স্তালিনের আমলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। লুহানী সম্পর্কে মতি ভাই জানতে পারেন ১৯৮১ সালে, দিল্লি সফরের সময়, বিজ্ঞানী কমিউনিস্ট নেতা গঙ্গাধর অধিকারীর কাছ থেকে। ৪২ বছর ধরে মতি ভাই লেগে থাকলেন এই এক বিষয় নিয়ে। অবশেষে ২০২৪-এ বেরোল বইটা।
২. লাল সালাম: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। আকাশ ভরা সূর্য তারা নামে তাঁর একটা বই আছে, ‘কবিতা-গান-শিল্পের ঝর্ণাধারায়’ উপশিরোনামে—অরুণ মিত্র, আলতাফ মাহমুদ, কামরুল হাসান থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত ২৭ জনের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি আর নৈর্ব্যক্তিক ভাবনা। তাঁর নেওয়া সাক্ষাৎকারগুচ্ছের বইয়ে ব্যক্তিত্বদের নামের তালিকা পড়লেই সমীহ জাগে—অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি, ফজলে হাসান আবেদ থেকে শুরু করে রুনা লায়লা।
সামান্যই বলতে পারলাম। কেউ যেন তাঁর সামনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে কথা বলতে যাবেন না। সব তথ্য মুখস্থ। এখনো বসে বসে দেখেন ইমরান খানের বোলিং। আবার সৌম্য সরকারের আপার কাটের ভক্ত। সৌম্য ভালো করলে খুশি হন। তামিম ইকবালের সঙ্গে দেখা করেন। শাকিব খানের সঙ্গেও। শামসুর রাহমানের সঙ্গে মিলে যৌথ বই আছে শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে।
পাবলো পিকাসোর ওপরে সব বই সংগ্রহে শুধু নয়, মুখস্থ! এরপর শুরু করবেন গল্প বলা, শোনো আনিস, শোনেন সাজ্জাদ, বুঝলেন সুমনা, জানো উৎপল, জাকারিয়া শোনো, শাবানা আজমির বাবা কাইফি আজমি কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি করতেন...কিংবা সুভাষদার (মুখোপাধ্যায়) বাসায় গেলাম, ঘরে একটামাত্র চৌকি, বিছানায় বই, মেঝেতে বই...টাইপরাইটারে উবু হয়ে বসে লেখেন...বলেছিলেন, আবার এলে রংপুরের পাতার বিড়ি নিয়ে এসো। আর যাওয়া হলো না…
এই রকম এক দুপুরের খাবারের আড্ডায় প্রথম আলো অফিসে মতি ভাই আমাদের বলেছিলেন, দেখো, যারা শিল্প-সাহিত্য-সাংবাদিকতায় ভালো করেন, তাঁদের একটা কমন জিনিস আছে। তাঁরা সবাই দেশের আর মানুষের ভালো চাইতেন। নিজের জন্য কিছু চাইতেন না। মানুষের উপকার করার জন্য কাজ করতেন। মানুষের উপকার করা। এই একটা জিনিস আমাদের কাগজের মধ্যে যেন থাকে। সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ... তাঁদের জন্য আমরা যেন একটা কিছু করি...এই ব্যাপারটা আমাদের কাগজের মধ্যে থাকতে হবে...
সেদিনের সেই তারিখ-না-লিখে থাকা দুপুরে মতি ভাইয়ের প্রথম আলোর এবং সব কাজের পেছনের স্বপ্নটা আমরা অনুভব করতে পেরেছিলাম। আমরা সবাই, প্রথম আলোর নবীনতম কর্মী, মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে চলা অফিস সহকারী, প্রথম আলোর লাইব্রেরি বা আর্কাইভের কর্মী, কিংবা জেলা শহরের বিক্রয় প্রতিনিধি—সবার মধ্যে এই একটা স্বপ্ন কিন্তু কাজ করে, আমরা প্রথম আলো করি, আমরা ভালো গণমাধ্যম হতে চাই, আমরা ভালো থাকতে চাই, আমরা সৎ-বস্তুনিষ্ঠ-আধুনিক গণমাধ্যম হতে চাই, কিন্তু যা কিছুই আমরা করি না কেন, আমরা মানুষের উপকার করতে চাই, সাধারণ মানুষ, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ, প্রান্তিক মানুষ, ব্যক্তি মানুষ এবং সম্মিলিত মানুষ। যাদের জোড়া দিলে হবে দেশ। আমরা বাংলাদেশের ভালো চাই। আমরা বাংলাদেশের জয় চাই।
প্রথম আলোর ঘোষণাপত্র হলো এটাই—বাংলাদেশের জয়।
৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই দিনে আমরা নিজেদের বারবার মনে করিয়ে দিতে চাই, আমাদের সব কাজ, সব চেষ্টার অভিমুখ যেন হয় বাংলাদেশের জয়।
ঢাকা, ৩ নভেম্বর ২০২৫
আনিসুল হক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক