বিশেষ সাক্ষাৎকার: চীনের রাষ্ট্রদূত
চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল
২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে চীনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন লি জিমিং। তিন বছরের বেশি সময় বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা, বিনিয়োগসহ দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের নানা প্রক্রিয়ায় এ সময় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি ভূরাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে আপনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে তিন বছর কাজ করার সময় উল্লেখযোগ্য একটি পর্ব ছিল কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের লড়াইতে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে নিজের কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
লি জিমিং: বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনের বড় সময় ছিল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইতে। তবে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কাজেই একেবারে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে এই সময়ে দায়িত্ব পালন করাটা ছিল একটা সুযোগ। চীন ও বাংলাদেশ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হয়েছে। মহামারির এই পর্বে দুই দেশের জনগণ একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে আমরা শুধু বাংলাদেশ সরকার নয়, এখানকার জনগণের কাছ থেকে অনেক স্বাস্থ্যসামগ্রী উপহার হিসেবে পেয়েছি। এ সময়ে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তা স্মরণীয়। কাজেই এই সময়কালে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য এটা ছিল আমার জন্য বিশেষ এক সুযোগ। আমার পুরো চাকরিজীবনে সবচেয়ে মনে রাখার মতো স্মৃতি থাকবে বাংলাদেশকে ঘিরে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: করোনাভাইরাস মোকাবিলার সময় বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ করতে গিয়ে সংকটে পড়েছিল। চীন এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। মহামারি মোকাবিলায় দুই দেশ কীভাবে একে অন্যকে সহযোগিতা করেছিল?
লি জিমিং: করোনাভাইরাস সংক্রমণের পুরো পর্বে দুই দেশ হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, শুরুতে বাংলাদেশই আমাদের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। এরপর চীন নিজের সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করেছে বাংলাদেশকে। শুরুতে বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশ টিকা নিয়ে সংকটে পড়ার পর আমি টিকা দিয়ে সহায়তার জন্য বেশ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু টিকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা পশ্চিমা পাঁচ দেশের অনুমোদন বাধ্যতামূলক ছিল বলে বাংলাদেশ তখন টিকা নিতে পারেনি। ওই সময়টাতে সব টিকাই ছিল নতুন। চীনের সিনোফার্ম বা সিনোভ্যাক তখনো অনুমোদন পায়নি। বাংলাদেশের টিকার চাহিদা ছিল আর চীনও টিকা দিতে রাজি, কিন্তু অনুমোদনের জন্য অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। দুই পক্ষের যৌথ উদ্যোগের ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের আগেই চীনের টিকা ব্যবহারের জরুরি অনুমোদন দিয়ে দেয় বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তখন তাদের অনুমোদন দিয়ে দেবে বলে জানায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, যেটা না বললেই নয়।
বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পরপর আমরা সময়মতো বিপুলসংখ্যক টিকা সরবরাহ করেছিলাম। খুব দ্রুত আমরা বাংলাদেশকে ৫০ কোটির বেশি টিকা উপহার হিসেবে দিয়েছি। এরপর বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে টিকা বিক্রি এবং যৌথ উৎপাদনের জন্য চীনের টিকা উৎপাদনকারীরা আলোচনা শুরু করেছিলেন। এখন পর্যন্ত চীনা টিকার মাধ্যমে বাংলাদেশে সাড়ে ১৭ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, যা মোট টিকার ডোজের ৫২ শতাংশ। চীনের এই টিকার হার অন্য সব দেশের চেয়ে অনেক বেশি। টিকা ছাড়াও মহামারির বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইয়ের অংশ হিসেবে আমরা চিকিৎসাকর্মী এবং পিপিই ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলাম।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা কখনো উল্লেখ করা হয়নি। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত হ্রাসকৃত ঋণের আওতায় আমরা ইনফো সরকার—তৃতীয় ধাপের প্রকল্পে সমর্থন দিয়েছি। প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল, জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোর উন্নয়ন। করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণে লকডাউনের সময় অবকাঠামোর সংযুক্তি, অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপনের ফলে বাংলাদেশ সরকার ঢাকা থেকে উপজেলা স্তর পর্যন্ত কাজ অব্যাহত রেখেছিল। এটি সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: চট্টগ্রামে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চলছে। দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে কোন কোন খাতকে চীন সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে?
লি জিমিং: এখন যেটি সেখানে রয়েছে চীনের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হবে তার চেয়ে একেবারে আলাদা। এটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা নয়, একটি অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল হবে। সেখানে কিছুসংখ্যক তৈরি পোশাককারখানা হয়তো থাকবে, কিন্তু সেটাই মূল শিল্প হবে না। তাহলে সেখানে কী হবে? বলা হচ্ছে, এই অঞ্চলটিতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, সৌর ব্যাটারি, সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি, তথ্যপ্রযুক্তির মতো বিষয়গুলোতে প্রাধান্য দেব। এসব খাতে চীন যথেষ্ট ভালো এবং এগুলোর সম্ভাবনাও বেশি।
* দুই দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে আস্থা অত্যন্ত সন্তোষজনক;
* আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমারকে নমনীয় করা যাবে না;
* আইপিএস এ অঞ্চলে অনেক বেশি অস্থিতিশীলতা তৈরি করায় চীন তা পছন্দ করছে না;
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নতুন খাত হিসেবে আপনি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি এবং নতুন দিনের প্রযুক্তিতে জোর দিচ্ছেন?
লি জিমিং: শুধু তৈরি পোশাকশিল্প নয়, বাণিজ্য আর বিনিয়োগের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির শিল্পকে লক্ষ্য ধরে আমাদের এগোনো উচিত। অন্যান্য রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় আমাদের তৈরি পোশাকের জন্য অনেক জায়গা এর মধ্যেই বরাদ্দ করা হয়েছে। নতুন এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে আমাদের উচ্চ প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার চীন তাদের বাজারে এ দেশের ৯৮ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। তারপরও বাণিজ্যবৈষম্য বেড়েই চলেছে। অসম এই বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে চীনের দিক থেকে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
লি জিমিং: দেখুন, বাণিজ্যে যে ঘাটতি আছে, সেটা যে বাংলাদেশের জন্য সব সময় খারাপ, তা কিন্তু নয়। আপনি সংখ্যার দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, বাণিজ্যবৈষম্যের এক-তৃতীয়াংশ কিন্তু চীন থেকে কেনা কাঁচামাল। এটা অন্য দেশের বাজারে আপনার উৎপাদিত রপ্তানি পণ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এরপর এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য। বাকি এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে সেতু, রেলসংক্রান্ত যন্ত্রপাতিসহ অবকাঠামো সুবিধার জন্য। কাজেই বাণিজ্য বা পণ্যের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে আপনাদের লেনদেনের সবটাই বাংলাদেশের স্বার্থে হচ্ছে। কাজেই আমাদের কম কেনা উচিত এবং বেশি বিক্রি করা উচিত—এমনটা কখনোই ভাববেন না। এ ধারণা সব সময় ঠিক হয় না।
আমরা চট্টগ্রামে চীনের অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চলে উন্নত প্রযুক্তির শিল্পোৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা করছি। এটা ঘটলে বাংলাদেশের আরও অনেক বেশি পণ্য প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে চীনের বাজারে। আমরা বাংলাদেশের শিল্পের জন্য চীনের বাজার খুলে দিয়েছি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: অঞ্চল এবং পথের উদ্যোগের (বিআরআই) সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর পদ্মা রেল সেতু প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্পে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন। বিআরআইয়ের আওতায় দুই দেশের সহযোগিতার সবশেষ পরিস্থিতি কেমন?
লি জিমিং: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম বিআরআইতে যুক্ত হয়। বিআরআইয়ের আওতায় চীন-বাংলাদেশের সহযোগিতা বেশ ফলপ্রসূ, যার সুফল পেয়েছে দুই দেশের জনগণ। এই রূপরেখার আওতায় ভবিষ্যতে আমরা গভীর সহযোগিতা দেখতে পাব।
তবে এখানে কিছু বিষয় রয়ে গেছে, যা আমাদের সমাধান করা উচিত। প্রথমত, বিআরআইকে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ দেখে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। বিআরআই মানে শুধু সংযুক্তি, অবকাঠামো এবং হার্ডওয়্যার নয়, এটি কিন্তু নীতির সমন্বয়, বাণিজ্য সুবিধা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং জনগণের বিনিময় বোঝায়। বিআরআইতে অন্তত পাঁচটি উপাদান রয়েছে। কাজেই আমরা যখন বিআরআই নিয়ে কথা বলি, আমরা কখনোই শুধু সংযুক্তিতে গুরুত্ব দিই না। কাজেই বিআরআইকে শুধু সংযুক্তি হিসেবে দেখাটা ভুল হবে।
দ্বিতীয়ত, বিআরআইতে আমরা উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার কথা বলি। সিপিসির ২০তম কংগ্রেসের পর কমিউনিস্ট পার্টি চীনের আধুনিকায়নের নতুন যাত্রার ঘোষণা দিয়েছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে উচ্চ মানের বিআরআই সহযোগিতা জরুরি। এর মানে হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের উন্নয়নের স্বার্থে আরও বেশি সবুজ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। উচ্চ পর্যায়ের এই বিআরআইয়ের মধ্য দিয়ে অনেক বেশি বিষয় অর্জিত হবে।এখন আমরা যেটা লক্ষ করছি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশর সঙ্গে আরও বেশি সহযোগিতা দেখতে পাব।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশে ঐতিহাসিক সফরের সময় এ দেশের ২৭ প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ছয় বছর পর ওই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন খুব ধীরগতির এবং অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও সন্তোষজনক নয়। বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
লি জিমিং: যে সমঝোতা স্মারকগুলো সই হয়েছিল, তা শুধু বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ছাড়কৃত ঋণের প্রতিশ্রুতি নয়। তালিকার প্রকল্পগুলো দুই পক্ষ বাস্তবায়ন করবে, শুধু চীন নয়। সমঝোতা স্মারকে নজর দিলে দেখতে পাবেন, এগুলো আমাদের সহযোগিতার অগ্রাধিকার, যার কিছু চীনের হ্রাসকৃত ঋণে এবং কিছু প্রকল্পের অর্থায়ন অন্য প্রক্রিয়ায়। আবার ওই তালিকার কিছু প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমার জানা মতে, এখন পর্যন্ত ২৭টি প্রকল্পের এক-তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে অথবা নির্মাণাধীন। অন্য দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে অর্ধেক প্রকল্প বিবেচনাধীন এবং বাকি অর্ধেক এখনো স্থগিত রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ সরকার এ প্রকল্পগুলো শুরু করেনি, কিংবা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর বিষয়ে। চীন হ্রাসকৃত ঋণ অনুমোদন করলেও বাংলাদেশ সরকার না করেছিল। বাংলাদেশ অবস্থান পরিবর্তন করার ফলে এটি আর তালিকায় যুক্ত হয়নি। আমাদের এ জন্য অন্য পথ খুঁজে নিতে হয়। এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আমরা বলেছি, একটির পরিবর্তে অন্যটি নেওয়া যেতে পারে। আর আমাদের যে প্রক্রিয়া, তাতে প্রকল্প বাদ দেওয়া এবং নতুন প্রকল্প যুক্ত করার বিধান রয়েছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে মাঝেমধ্যে বলা হয়ে থাকে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু হয়নি, তা ঠিক নয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: গত দুই বছরে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নিয়মিত বিরতিতে নানা পর্যায়ে যোগাযোগ লক্ষ করেছি। দুই শীর্ষ নেতার এই যোগাযোগকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
লি জিমিং: দুই দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে আস্থা অত্যন্ত সন্তোষজনক। দুই দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে গত দুই বছরে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ফোনে সরাসরি আলাপ, চিঠি বিনিময়, ভিডিও বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতাদের এই যোগাযোগ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি, তা আমাদের আরও সমন্বিত উপায়ে দুই দেশের সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশনার মূল চাবিকাঠি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংহি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয়ের পাশাপাশি তাঁরা দুজনই ভূরাজনীতির বিষয়ে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের কাছে আপনাদের প্রত্যাশাটা কী?
লি জিমিং: ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরও বেশি অনিশ্চয়তা এবং অস্থিতিশীলতা তৈরির লক্ষ্যে ছোট একটি গোষ্ঠীর কোনো ধারণা চীন স্পষ্টতই পছন্দ করছে না। বাংলাদেশও তা পছন্দ করে না। বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের প্রজ্ঞার প্রতি আমরা আস্থাশীল। কারণ, সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়, এটি সব সময় বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের নীতি।
কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থায় বাংলাদেশ যুক্ত হবে না বলে আমাদের ধারণা। আমরা মনে করি, কাউকে কাউকে বাদ দিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ এ অঞ্চলে আরও বেশি অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিও একই হবে।
কয়েক দশক আগে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও সে সময়কার মানসিকতা এখনো রয়ে গেছে। ইউরোপের দিকে তাকান, স্নায়ুযুদ্ধকালে মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ন্যাটোর সম্প্রসারণে কী ঘটেছে? একই ধরনের মানসিকতার বিস্তার যদি এই অঞ্চলে ঘটে, তাহলে আমরা কী আশা করতে পারি?
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে চীন। তারিখ ঘোষণা হলেও শেষ পর্যন্ত প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই সংকট এখন কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?
লি জিমিং: বিষয়টি সমাধানের জন্য আমি অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলাম। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখন পর্যন্ত এতে ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি হয়নি। দেখা যাক, সামনে কী সম্ভাব্যতাগুলো আছে।
প্রথম সম্ভাবনা হিসেবে লোকজন এখন তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণের কথা বলছে। তুরস্ক কিছু শরণার্থীকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। তাদের নিজস্ব একটা নীতি আছে। কিন্তু এটা কি বাংলাদেশের জন্য বিকল্প হতে পারে? এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
দ্বিতীয়ত সম্ভাবনা হিসেবে লোকজন চাইছে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর আরও বেশি চাপ দেওয়া হোক। এমন ভাবনার কারণটা আমি জানি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়ায় কাজে ফল আসবে বলে হয় না। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা কিংবা অন্য উদ্যোগই হোক না কেন, এতে কাজ হবে না। কেন? দেখুন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চার দশকের বেশি সময়জুড়ে ক্ষমতায় আছে। এই সময়কালে তারা সব সময় আন্তর্জাতিক চাপে থেকেও নিজেরা টিকে থেকেছে। রোহিঙ্গা সমস্যার চেয়েও অনেক বেশি জটিল সমস্যা তাদের সামনে রয়েছে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের যে প্রান্তিক প্রভাব, সেটিও কমেছে।
এরপর আমরা তৃতীয় এবং শেষ সম্ভাবনার বিষয়ে আসি, যেটি হলো, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ আছে, সেটি পাঁচবার আলোচনায় বসেছিল। এটিকে ব্যাপকভাবে সফল বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া জটিলতার মুখে রয়েছে তবে যে কোনোভাবেই হোক না কেন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সম্ভবত পরিস্থিতি যাতে আরও অনুকূল হয়, সে জন্য আমাদের আরও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা উচিত। তা না হলে কিন্তু আমরা যদি একদল রোহিঙ্গাকে পাঠিয়ে দিই এবং তারা যদি খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তবে পরের দলগুলোকে পাঠানো মুখ থুবড়ে পড়বে। কাজেই আমরা ঝুঁকি নিতে পারি না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বাংলাদেশ ও চীনের জনগণের সম্পর্ক বিনিময়ের বিষয়ে আপনি কী প্রত্যাশা করেন?
লি জিমিং: এক দশক ধরে আমরা দুই দেশের জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিনিময় লক্ষ করেছি, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে বলে আশা করি। এখন পর্যন্ত চীনের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষার কোর্স চালু করেছে। বাংলাদেশের ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করছেন। চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি প্রাদেশিক সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশে চীনা অধ্যয়নকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। চীনা অধ্যয়নের বিষয়ে দখল আছে—এমন আরও বেশি সংখ্যায় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এবং গবেষকের প্রয়োজন এখানে আছে। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোরও নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, দুই দেশের এবং দুই দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
লি জিমিং: আপনাকেও ধন্যবাদ।