ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাই প্রধান চ্যালেঞ্জ

ভোটার হওয়ার নিশ্চয়তা থাকলেও সব নাগরিক যে তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন, গত দেড় দশকে সে নিশ্চয়তা দিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এমন এক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ রোববার পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় ভোটার দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘তোমার আমার বাংলাদেশে, ভোট দিব মিলেমিশে’।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, তাতেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে বা নির্বাচন অবাধ হবে, তা বলার সুযোগ নেই। সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচনব্যবস্থায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে হবে। ইতিমধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সরকারকে প্রতিবেদন দিয়েছে। সে সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের নির্বাচনী কাঠামো গুঁড়িয়ে দেয়। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও অনিয়ম এবং ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বিরোধীদের বর্জনে সর্বশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও ছিল একতরফা।

ভোটাধিকার ধ্বংস করে ভোটার দিবস চালু করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা ১ মার্চকে জাতীয় ভোটার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ‘ভোটার হব, ভোট দিব’ প্রতিপাদ্য নিয়ে কে এম নূরুল হুদার কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি প্রথমবার পালন করে ২০১৯ সালে। পরে ২০২০ সালে ভোটার দিবস একদিন পিছিয়ে ২ মার্চ নির্ধারণ করা হয়। এরপর থেকে ২ মার্চই দিবসটি পালন করা হয়। আজ দিবসটি উপলক্ষে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে নির্বাচন কমিশন। এদিন হালনাগাদ চূড়ান্ত ভোটার তালিকাও প্রকাশ করা হবে।

নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন কমিশনও স্বাধীনভাবে কাজ করেনি। ভোটের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকে পুলিশ ও প্রশাসন। দলীয় সরকারের অধীন তারাও সরকারি দলের পক্ষে কাজ করে। অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন নির্বাচন হবে। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সুযোগ বেশি।

তবে এখন পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে মূল চিন্তার কারণ হবে পুলিশ ও প্রশাসনের সক্ষমতা। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে থাকে মূলত পুলিশ। আর সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রশাসনেও এখনো পুরো শৃঙ্খলা ফেরেনি।

অন্যদিকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচন কমিশনও পুরোপুরি নতুন। তাদের কোনো নির্বাচন পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা নেই। ফলে নতুন কমিশনের সক্ষমতা এবং পুলিশ ও প্রশাসন কতটা দায়িত্ব পালন করতে পারবে, তার পরীক্ষা এখন পর্যন্ত হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ সরকারকে দিয়েছে, সেগুলো কতটা কার্যকর হয়, সেটির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে।

গত দেড় দশকে অনেক মানুষ ভোটে আগ্রহ হারিয়েছেন। অনেকে ভোটার হননি। সবাইকে ভোটার তালিকাভুক্ত করা একটি চ্যালেঞ্জ।
আবদুল আলীম, নির্বাচনবিশেষজ্ঞ

নির্বাচনবিশেষজ্ঞ আবদুল আলীম প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্টের পর এখনো কোনো নির্বাচন হয়নি। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন ভোটাধিকার প্রয়োগে ঝামেলা হয় না। তবে গত দেড় দশকে অনেক মানুষ ভোটে আগ্রহ হারিয়েছেন। অনেকে ভোটার হননি। সবাইকে ভোটার তালিকাভুক্ত করা একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি আশা করেন, আগামী নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। ভয় কাজ করলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। এ জন্য একটি ‘সমন্বিত নির্বাচনী নিরাপত্তাব্যবস্থা’ পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।

দিনক্ষণ ঠিক না হলেও আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছে না। নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এবারের জাতীয় ভোটার দিবসের প্রতিপাদ্যের মর্মার্থ হচ্ছে, ইসি মনে করে না স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভোটের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ আছে। নির্বাচন কমিশন খুব শক্ত এবং নিরপেক্ষভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি সর্বোৎকৃষ্ট নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং একটি কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বৈরাচার আকাশ থেকে পড়েনি। বিদ্যমান বিধিবিধান, আইন–বিধি, পদ্ধতি-প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। নির্বাচনী অঙ্গন ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। টাকার খেলা এবং পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক

আচরণ বন্ধ করা, নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ও দায়বদ্ধতার অধীন করা, প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য যাচাইয়ের মতো বেশ কিছু কাজ করতে হবে। এসব করতে বেশ কিছু আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।