যুদ্ধদিনের অদেখা সব ছবি এখন দৃকে

‘ঘরে ফেরার দীর্ঘ যাত্রা’আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখছেন দর্শনার্থীরা। গতকাল রাজধানীর পান্থপথের দৃক গ্যালারিতে
ছবি: আশরাফুল আলম

মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে একজন অসুস্থ নারীকে। তাঁর শরীরে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। পাশেই স্যালাইনের বোতল উঁচু করে ধরে রেখেছেন একজন পুরুষ। এমনই একটি ছবির দেখা পাওয়া যাবে রাজধানীর দৃকের লাইব্রেরিতে গেলে। ছবিটি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা। তুলেছেন ভারতীয় আলোকচিত্রী অমিয় তরফদার। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তোলা অদেখা এমন অনেক ছবি দৃকের লাইব্রেরিতে জায়গা পেয়েছে।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় দৃক গ্যালারিতে শুরু হয়েছে অমিয় তরফদারের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ঘরে ফেরার দীর্ঘ যাত্রা’। দৃকের ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এ প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছে। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দৃকের প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা ও প্রদর্শনীর কিউরেটর এ এস এম রেজাউর রহমান।

দৃকের প্রদর্শনীতে থাকা অমিয় তরফদারের তোলা বেশির ভাগ ছবি যুদ্ধের ময়দানে তোলা। একটি ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পেট্রাপোল সীমান্তে আসা একদল মুক্তিযোদ্ধাকে দেখা যায়। এ ছাড়া কোনো ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের পরামর্শ করতে, কোনো ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াদাওয়া করতে, আবার কোনোটিতে সম্মুখযুদ্ধে জয়ের পর তাঁদের উল্লাস করতে দেখা যায়।

এ এস এম রেজাউর রহমান বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের অদেখা এসব ছবি অমিয় তরফদারের পরিবারের সদস্যদের কাছে ছিল। তাঁরা চাইতেন ছবিগুলো বাংলাদেশের কেউ সংগ্রহ করুক। এ জন্য তাঁরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছেন। অবশেষে দৃক এসব ছবি নিজেদের সংগ্রহশালায় যুক্ত করল। আলোকচিত্রীর পরিবারের সদস্যরা সানন্দে এসব ছবি দৃকের হাতে তুলে দিয়েছেন।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, ‘অমিয় তরফদার একই সঙ্গে বাংলাদেশের, আবার তিনি তা নন। তাঁর চোখে উঠে এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যা আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে, সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর ছবিতে অভিব্যক্তিগুলো খুব গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের সমতল ভূমিতে যুদ্ধের যে প্রস্তুতি দরকার, সেটা কারোই ছিল না।

প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার লুঙ্গি পরা সাধারণ মানুষের যে যুদ্ধ, তার নানা আঙ্গিক এই ছবিগুলোতে উঠে এসেছে।’

শহিদুল আলম বলেন, ‘দৃক শুরু হয়েছিল প্রতিবাদের একটি ক্ষেত্র হিসেবে। মানুষের প্রতিবাদ করার জায়গাগুলো কমে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দৃক এগিয়েছে, বড় হয়েছে, কিন্তু তার লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটেনি, ঘটবেও না।’

অমিয় তরফদারের জন্ম ১৯৩৫ সালে, রাজশাহীতে। শুরুতে থাকতেন বাংলাদেশ অংশের দক্ষিণ দিনাজপুরে। পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় থিতু হন।

পরিবারের ছিল স্টুডিও ব্যবসা। তিনি ক্রীড়া–আলোকচিত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ভারতের হয়ে অলিম্পিক ও ফুলবল বিশ্বকাপের ছবি তুলতে গিয়েছিলেন তিনি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অমিয় তরফদার ক্যামেরা হাতে চলে যান সীমান্ত এলাকায়। ছবি তুলে ফিল্ম পাঠাতে শুরু করেন বাড়িতে। পারিবারিক স্টুডিওতে সেগুলো ডেভেলপ করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠাতেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

অমিয় তরফদারের তোলা রিকশা-ভ্যানে মৃতদেহ পড়ে থাকার ছবিটি মুক্তিযুদ্ধকালের অন্যতম পরিচিত ছবি। এই ছবি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার কয়েকটি পত্রিকায়।

ছবিটি প্রকাশ করেছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম নিউজউইক। অমিয় তরফদার ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে তাঁকে বিশেষ সম্মাননা জানিয়েছে।

অমিয় তরফদারের ছবিগুলো নিয়ে দৃকের এ প্রদর্শনী ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলবে।