দুদকের ফাঁদ কমে গেছে

দুদকে গত পাঁচ বছরে মোট ৯০ হাজার ৫৯৩টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে বাতিলের খাতায় চলে যায় ৭২ হাজার ৬৩১টি অভিযোগ

২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু সিংহভাগ অভিযোগই চলে গেছে বাতিলের খাতায়। গত বছর (২০২২) দুদক ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ পায়। এর মধ্যে মাত্র ৯০১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য বিবেচিত হয়। বাকি ৭৯ শতাংশ অভিযোগই বাতিলের খাতায় চলে গেছে।

এ ছাড়া হাতেনাতে দুর্নীতি ধরার ‘ফাঁদ মামলা’ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘গণশুনানি’ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রমেও ভাটা পড়েছে। দুদকের তৈরি করা ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাতে দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা বার্ষিক প্রতিবেদনটি তুলে দেন।  

দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ১৯ হাজার ৩৩৮টি দুর্নীতির অভিযোগ তাদের দপ্তরে জমা পড়ে। যাচাই-বাছাই শেষে ৯০১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়। আগের বছর ২০২১ সালে অভিযোগ জমা পড়েছিল ১৪ হাজার ৭৮৯টি। সেখান থেকে ৫৩৩টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয়। তার আগে ২০২০ সালে অভিযোগ জমা পড়ে ১৮ হাজার ৪৮৯টি। সেখান থেকে মাত্র ৮২২টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য বাছাই করা হয়। এ ছাড়া দুদকের হটলাইন ১০৬ নম্বরে গত বছর ৩৯ হাজার ৪৮৮টি ফোন কল আসে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৬২টি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়। আগের বছর ২০২১ সালে হটলাইনে ফোন এসেছিল ৩৯ হাজার ২৬৭টি। এর মধ্যে ১ হাজার ১২টি অভিযোগ রেকর্ড করা হয়।

সব দিক দিয়ে (অভিযোগ, অনুসন্ধান, মামলা) দুদকের কার্যক্রম আগের চেয়ে ভালো। শুধু মামলার তদন্তে একটু দুর্বলতা আছে
মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ, চেয়ারম্যান, দুদক


দুদক বলছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় এবং অধিকাংশ অভিযোগই দুদকের তফসিল–বহির্ভূত হওয়ায় অনুসন্ধানের জন্য বিবেচিত হয় না। আর্থিক দুর্নীতির চেয়ে বেশির ভাগ অভিযোগ আসে মাদক, প্রশাসনিক, ব্যক্তিগত। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই তুচ্ছ ও ঢালাও অভিযোগ থাকে। কমিশন যাচাই-বাছাই করে নতুন অভিযোগ আমলে নেয়। সে কারণেই অনুসন্ধানের জন্য কম অভিযোগ নেওয়া হয়।

দুদকের এক হিসাবে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তাদের কাছে মোট ৯০ হাজার ৫৯৩টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে বাতিলের খাতায় চলে যায় ৭২ হাজার ৬৩১টি অভিযোগ। আর ১৩ হাজার ৫৪১টি অভিযোগ অনুসন্ধান না করে দুদক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। মাত্র ৫ হাজার ২৩১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য বাছাই করে।

ফাঁদ পেতে হাতেনাতে দুর্নীতি ধরা বেশ কার্যকর একটি কৌশল। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত বছর ফাঁদ মামলার তদন্ত হয় চারটি। আগের বছর হয়েছিল ছয়টি। তার আগে ২০১৮ সালে ১৫টি, ২০১৯ সালে ১৬টি ও ২০২০ সালে ১৮টি ফাঁদ মামলা হয়েছিল।

দুদক সূত্র জানায়, কয়েকটি উৎস থেকে তাঁদের কাছে দুর্নীতির অভিযোগ আসে। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আসা অভিযোগের পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ দুদকের তথ্যের অন্যতম উৎস। এ ছাড়া ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রতিবেদন আকারে পাওয়া তথ্য, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো প্রতিবেদন, দুদকের কর্মকর্তাদের সংগৃহীত অভিযোগ এবং আদালত থেকে প্রেরিত পিটিশন কিংবা সিআর মামলা দুদকের অনুসন্ধানের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জমা পড়া অভিযোগটি দুদকের তফসিলভুক্ত কি না। তা ছাড়া অভিযোগটি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ ও দুর্নীতি দমন বিধিমালা-২০০৭ মোতাবেক কাজ শেষে আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা যাবে কি না।

এসব মানদণ্ডে দুর্নীতির কোন অভিযোগটির অনুসন্ধান হবে, কোনটির হবে না—সেটি নির্ধারণ করে দুদকের ‘যাচাই-বাছাই কমিটি’। এ কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানযোগ্য অভিযোগগুলো কমিশনারের (অনুসন্ধান) কাছে যায়। তাঁর অনুমোদনের পর অনুসন্ধানকারী দল গঠন করে অনুসন্ধান শুরু হয়।

২০১৩
দুর্নীতি দমন কমিশনে বর্তমানে নতুন-পুরোনো মিলে ২ হাজার ১৩টি মামলার তদন্ত চলমান আছে

দুদক জানায়, পূর্ববর্তী বছরগুলোর অনিষ্পন্ন অনুসন্ধানসহ বর্তমানে ৪ হাজার ৬৩৩টি অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন আছে। গত বছর দুদক ১ হাজার ১১৯টি অভিযোগের অনুসন্ধান করে ৪০৬টি মামলা দায়ের করে। তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে ১ হাজার ৪৪টি অভিযোগের অনুসন্ধান শেষে দুদক ৩৪৭টি মামলা করেছিল। বর্তমানে নতুন-পুরোনো মিলে ২ হাজার ১৩টি মামলার তদন্ত চলমান আছে বলে বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে দুদক। গত বছর দুদক ৩৩১টি মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে। যা আগের বছরের চেয়ে ৯৩টি কম।

এ বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব দিক দিয়ে (অভিযোগ, অনুসন্ধান, মামলা) দুদকের কার্যক্রম আগের চেয়ে ভালো। শুধু মামলার তদন্তে একটু দুর্বলতা আছে। সেটিকেও আমি দুর্বলতা বলব না। কারণ, আমরা মানসম্পন্ন তদন্ত চাই। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে পুনঃ তদন্তের জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে। সে কারণে তদন্ত নিষ্পত্তি কম হয়েছে।’

দুর্নীতি প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক গণশুনানিও ব্যাপকভাবে কমে গেছে। গত এক বছরে গণশুনানি হয়েছে তিনটি। আগের বছর হয়েছিল মাত্র একটি। যদিও ২০১৮ সালে ২৭টি, ২০১৯ সালে ৩৮টি ও ২০২০ সালে ৫টি গণশুনানি হয়েছিল।

দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ফাঁদ পেতে হাতেনাতে দুর্নীতি ধরা বেশ কার্যকর একটি কৌশল। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত বছর ফাঁদ মামলার তদন্ত হয় চারটি। আগের বছর হয়েছিল ছয়টি। তার আগে ২০১৮ সালে ১৫টি, ২০১৯ সালে ১৬টি ও ২০২০ সালে ১৮টি ফাঁদ মামলা হয়েছিল। একইভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক গণশুনানিও ব্যাপকভাবে কমে গেছে। গত এক বছরে গণশুনানি হয়েছে তিনটি। আগের বছর হয়েছিল মাত্র একটি। যদিও ২০১৮ সালে ২৭টি, ২০১৯ সালে ৩৮টি ও ২০২০ সালে ৫টি গণশুনানি হয়েছিল।

অবশ্য দুদকের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা গত বছর গণশুনানি বন্ধ রেখেছি। এ বছর গণশুনানি বেশি হবে বলে আশা করি।’
আর ফাঁদ মামলার বিষয়ে মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ বলেন, ‘কেউ এসে তো অভিযোগ করবে, তার পরেই তো ফাঁদ পেতে ধরার চেষ্টা করব।’
সারা দেশে দুদকের ২২টি জেলা কার্যালয় থেকে বর্তমানে ৩৬টি হয়েছে। সে অনুযায়ী, অভিযোগের হার বাড়েনি। এ ছাড়া দুদকের জনবলও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সম্প্রতি দুদক ২৪৭ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনবল অনুযায়ী দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তকাজও সেভাবে বাড়েনি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জনবলের তুলনা করলে দুদকের সক্রিয়তা বাড়ার কথা, কিন্তু ঘাটতিই দেখা যাচ্ছে। এটা কি তাদের দক্ষতা, না সদিচ্ছার ঘাটতি—তা পরিষ্কার নয়। তবে এটি স্পষ্ট, দুদকে আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে, সেখানে তাঁর নাম-পরিচয় দেখে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নটি আছে।

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ফাঁদ পাতা কেন অব্যাহত রাখা হচ্ছে না, সেটিও পরিষ্কার নয়। গণশুনানি কমে যাওয়াটা উদ্বেগজনক। এটা খুব কার্যকর না হলেও দুর্নীতি প্রতিরোধে গণশুনানি একটি ফলপ্রসূ পন্থা।