কোরবানির গরু কিনে ঠকবেন না, যদি মানেন এসব পরামর্শ
আর মাত্র এক দিন পর পবিত্র ঈদুল আজহা। এই ঈদে কোরবানির গরু কেনা নিয়ে নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা, গবেষণা ও পশু স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এমলাফ) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সালমা সুলতানা। তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজনীন আখতার।
আর মাত্র এক দিন পর ঈদুল আজহা। কোরবানির গরু কেনায় ব্যস্ত ক্রেতারা—কেউ সরাসরি হাটে, কেউবা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। সারা বছর মাংস কেনা যাঁদের অভ্যাস, তাঁদের জন্য গরু কেনা নতুন অভিজ্ঞতা। তাই সুস্থ ও মাংসল গরু বাছাই করতে অনেকেই পড়ছেন দ্বিধায়। অনলাইনে গরু কিনতে ও কেনার পর যত্ন নিতে কোন বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, তা জানা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
কোরবানির গরু নিয়ে এমন নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা, গবেষণা ও পশু স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এমলাফ) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সালমা সুলতানা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাময়িকী এশিয়ান সায়েন্টিস্ট ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল এশিয়ার শীর্ষ বিজ্ঞানীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তার মধ্যে তিন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর একজন ছিলেন সালমা সুলতানা।
কেমন গরু কিনবেন
সুস্থ গরু কীভাবে চেনা যাবে?—এমন প্রশ্নের জবাবে সালমা সুলতানা বলেছেন, কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে সেটি সুস্থ কি না, তা সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে। সুস্থ গরুর নাক, মুখ ও চোখ পরিষ্কার ও উজ্জ্বল থাকে। শরীরের লোম মসৃণ ও চকচকে থাকে। গরুটি দ্রুত মাথা, কান ও লেজ নেড়ে মশা-মাছি তাড়াবে। খাওয়াদাওয়া স্বাভাবিক থাকবে, খাবারের পর জাবর কাটবে। গরুকে স্টেরয়েড দিয়ে মোটাতাজাকরণ করা হলে তা সহজে বোঝা যাবে। সে ক্ষেত্রে গরুর শরীরে চামড়ার নিচে পানি জমে যায়। গরুর শরীরে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে জায়গাটি যদি দেবে যায় ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় নেয়, তাহলে বুঝতে হবে গরুকে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে মোটা করা হয়েছে।
দেশি গরু চেনা যায় কীভাবে?—এ প্রসঙ্গে সালমা সুলতানা বলেন, দেশি গরুর মধ্যে চিটাগাং রেড ক্যাটল, মুন্সিগঞ্জ ব্রিড, পাবনা ক্যাটল, নর্থ বেঙ্গল গ্রে বেশি জনপ্রিয়। এর বাইরেও ঘরে ঘরে দেশি গরু পালন করা হয়। চিটাগাং রেড গরুর চোখের পাতা থেকে খুর, লেজের প্রান্ত সব লালচে রঙের হয়। গরুগুলো তুলনামূলক ছোট হয়। মুন্সিগঞ্জ ক্যাটল ‘মীরকাদিমের গরু’ হিসেবে পরিচিত। এ জাতের গরুর রং সাদা। দেহের বিভিন্ন স্থানে হালকা গোলাপি রঙের আভা থাকে। পাবনা ক্যাটল গরু লাল বা ধূসর অথবা এ দুই রঙের মিশেল হয়ে থাকে। মুখ, চোখের পাতা, শিং ও লেজের প্রান্ত কালো হয়। নর্থ বেঙ্গল গ্রে সাদা বা গাঢ় ধূসর রঙের হয়, ঘাড়ে ছাই রঙের ছোপ থাকে, লেজের প্রান্ত সাদা হয়। মুখ, চোখের পাতা ও খুর কালো হয়। শিং ছোট বা মাঝারি আকারের হয় ও ভেতরের দিকে বাঁকানো থাকে।
কোরবানির জন্য মাংসল পশু কিনতে চান এমন ক্রেতাদের উদ্দেশে বিজ্ঞানী সালমা সুলতানা বলেছেন, এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনতে হয় গরুর জাত (ব্রিড), শারীরবৃত্তীয় গঠন (অ্যানাটমি) এবং পালন ব্যবস্থাপনা। কারণ, গরুর ওজন, গঠন ও জাতভেদে মাংস উৎপাদনের ক্ষমতা ভিন্ন হয়। বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের গরু পাওয়া যায়—শুধু দুধের জাত, শুধু মাংসের জাত এবং দুধ-মাংস উভয় উপযোগী সংকর জাত। ফ্রিজিয়ান ও জার্সির মতো দুধের জাতগুলো দুধ বেশি দিলেও শরীর ছোট ও হালকা হওয়ায় মাংস কম হয়। অন্যদিকে ইউরোপীয় জাতের গরু বেশি মাংস দিলেও তা বাংলাদেশে সীমিতভাবে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সবচেয়ে লাভজনক হলো দেশি সংকর জাতের গরু, যেগুলো দেশি গরুর সঙ্গে শাহিওয়াল, রেড সিন্ধি বা ফ্রিজিয়ানের সংমিশ্রণ। এসব গরু তাপ সহনশীল, দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং অনুকূল ব্যবস্থাপনায় ভালো পরিমাণ মাংস উৎপাদন করে।
এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো, পেট মোটা গরু মানেই বেশি মাংস হবে। বাস্তবে, পেট মোটা হতে পারে অতিরিক্ত পানি, গ্যাস বা অন্ত্রের কারণে, যা মাংসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আবার শুকনা গরুর পেশি উন্নত হলে মাংস বেশি হতে পারে। তাই অভিজ্ঞ খামারিরা গরুর পেছনের ‘পিন বোন’ দেখেই মাংসের পরিমাণ ধারণা করেন। এই পিন বোন যদি চ্যাপটা বা পূর্ণ দেখায়, তাহলে বুঝতে হবে ওই অঞ্চলে পেশির পরিমাণ ভালো এবং সেই গরু থেকে মাংস বেশি পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে দেশি সংকর জাতের গরু, যার পিন বোন চ্যাপটা, দেহের গঠন ভারসাম্যপূর্ণ এবং খামারি পরিচর্যায় লালিত, সেই গরুই কোরবানির জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও মাংসল।
গরুর লাইভ ওজনের (সামগ্রিক ওজন) কী পরিমাণ মাংস হয়, জানতে চাইলে সালমা সুলতানা বলেন, সাধারণত একটি গরুর লাইভ ওজনের ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত অংশ মাংস হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ ৪০০ কেজি ওজনের গরুর প্রায় ২০০ থেকে ২২০ কেজি মাংস হতে পারে। এর সঙ্গে বাজারদর গুণ করে গরুর আর্থিক মূল্য হিসাব করা যায়, যা গরু কেনায় সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
সালমা সুলতানা আরও জানিয়েছেন, গরুর দাঁত দেখে বয়স বোঝা যায়। একটা পূর্ণবয়স্ক গরুর ৩২টা দাঁত থাকে। অনলাইনে গরু কেনার সময় বিশ্বস্ত ও রেটিং ভালো, এমন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কিনতে হবে। গরুর ভেটেরিনারি স্বাস্থ্য রেকর্ড ও টিকাকরণের কাগজপত্র দেখতে হবে। নিজে ওই খামারে যেতে না পারলে স্থানীয় কোনো প্রাণিচিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে গরুর শারীরিক অবস্থা জেনে নিতে হবে। গরুর আকৃতি ও ওজন বুঝতে বিক্রেতার সঙ্গে ভিডিও কলের মাধ্যমে গরুটি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যারা গরু কিনে কোরবানির আগপর্যন্ত খামারে রেখে দেন, তাঁদের জন্যও এই সতর্কতা মানতে হবে।
গরুর কেনার পরের যত্ন
কোরবানির গরু কিনলেই কাজ শেষ নয়। গরু বাসায় আনার পর কোরবানির আগপর্যন্ত যত্ন নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন সালমা সুলতানা। গরু কেনার পর সেটি শারীরিকভাবে ক্লান্ত ও মানসিকভাবে আতঙ্কিত থাকে; বিশেষ করে যদি সেটিকে দূর থেকে পরিবহন করে আনা হয়। এই সময়ে যত্নে সামান্য অবহেলাও গরুর রোগ, জ্বর বা ওজন কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। প্রথমেই গরুকে পরিচ্ছন্ন ও ছায়াযুক্ত বায়ু চলাচলযোগ্য জায়গায় রাখতে হবে। যেন গরুটি সেখানে নির্ভার হয়ে বিশ্রাম নিতে পারে। গরুর ক্লান্তি কাটাতে স্যালাইনজাতীয় তরল খাদ্য বিশেষ উপকারী। বাজারে পশুর জন্য আলাদা ভেটেরিনারি স্যালাইন পাওয়া যায়। তবে ঘরে বানানো ওরস্যালাইন বা গুড়ের স্যালাইন দেওয়া যায়। ৫ লিটার পরিষ্কার পানিতে দুই মুঠো গুড় ও দুই চিমটি লবণ মিশিয়ে পান করালে গরুর পানি ও ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতি পূরণ হয়।
তিনি আরও বলেন, বাসায় আনার পরপরই গরুকে খড় বা শুকনা ঘাস খাওয়াতে হবে। তবে তা গুড় বা স্যালাইনমিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে খাওয়ালে গরুর শরীরে দ্রুত শক্তি ফিরে আসে। গরুর খাবারে সবুজ ঘাস, শাকসবজি ও বিশুদ্ধ পানি রাখতে হবে। এতে গরুর হজম ঠিক থাকে এবং ওজন হারানোর আশঙ্কা থাকে না। অনেক সময় দীর্ঘ যাত্রা ও ভিড়ের চাপ থেকে গরুর শরীরে হালকা জ্বর দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় ওষুধ না দিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, বিশুদ্ধ পানি ও ঠান্ডা পরিবেশ নিশ্চিত করাই ভালো। আবহাওয়া গরম হলে ভেজা তোয়ালে দিয়ে গরুর গা মুছে দিলে স্বস্তি পাবে। মশার উপদ্রব থাকলে মশারি দিতে হবে।
সালমা সুলতানা আরও বলেন, পশুটি হয়তো আপনার ঘরে অল্প সময় থাকবে, কিন্তু সেই সময়টা যেন ভালোবাসা, সহানুভূতি ও পরিপূর্ণ যত্নে থাকে। এটা নৈতিক দায়িত্বও। যত্ন দিয়ে পালন করলে পশুটির মন শান্ত থাকবে, খাবার খাবে ভালোভাবে এবং কোরবানির দিন পর্যন্ত সুস্থ ও সবল থাকবে।