প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যু কার্যকরের সুযোগ মাত্র দুই চিড়িয়াখানায়, প্রশ্ন
দেশে প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যুর বিধান রেখে প্রথমবারের মতো আইন পাস হয়েছে গত ২৫ অক্টোবর। তবে এ আইন প্রযোজ্য হবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন মাত্র দুটি চিড়িয়াখানার ক্ষেত্রে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি চিড়িয়াখানা এবং সাফারি পার্কের জন্য একই বিধান থাকা দরকার।
ব্যথাহীন মৃত্যুর বিধান রেখে পাস হওয়া আইনটির নাম ‘চিড়িয়াখানা আইন ২০২৩’। এ আইনে চিড়িয়াখানার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের স্থাপিত ও পরিচালিত চিড়িয়াখানাসহ এ অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তরিত অন্য কোনো চিড়িয়াখানা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে মাত্র দুটি চিড়িয়াখানা—একটি মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা, অপরটি রংপুর চিড়িয়াখানা।
এর বাইরে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, খুলনা চিড়িয়াখানা ও নিঝুম দ্বীপ পার্ক রয়েছে। গাজীপুর ও কক্সবাজারে রয়েছে একটি করে সাফারি পার্ক। এ ছাড়া দেশে বেশ কিছু বেসরকারি চিড়িয়াখানা আছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাইরে থাকা এসব চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কে থাকা প্রাণী একই ধরনের সমস্যায় ভুগলে, সেগুলোর ব্যথাহীন মৃত্যু কার্যকর করা যাবে না।
দেশের চিড়িয়াখানাগুলোর যে সক্ষমতা, তাতে সুস্থ প্রাণী সুস্থ রাখতেই হিমশিম খেতে হয়। সেখানে অসুস্থ প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন। অসুস্থ প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণ করতে গেলে সুস্থ প্রাণীগুলোই সংকটে পড়ে যায়। আইন করার সময় আলোচনায় হয়তো এসব বিষয় আসেনি।মো. আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
চিড়িয়াখানা আইনের ১৩ নম্বর ধারার ১ উপধারা অনুযায়ী, ‘চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণীর বয়সজনিত শারীরিক অক্ষমতা বা সংক্রামক রোগ থেকে অন্য কোনো প্রাণীর জীবন রক্ষার্থে বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট প্রাণীর অসহনীয় ক্লেশ (যন্ত্রণা) নিবারণের জন্য ব্যথাহীন মৃত্যু ঘটানো যাবে।’
জানতে চাইলে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনটি শুধু প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন চিড়িয়াখানার জন্য প্রযোজ্য। ভবিষ্যতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন আরও চিড়িয়াখানা হলে, সেগুলোর জন্যও আইনটি প্রযোজ্য হবে।’
সাফারি পার্ক দুটি বন বিভাগের অধীনে। বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে অসুস্থ প্রাণী আছে। তবে এখানে ব্যথাহীন মৃত্যুর বিধান প্রযোজ্য হবে না।
যেভাবে ব্যথাহীন মৃত্যু কার্যকর
আইন অনুযায়ী, ব্যথাহীন মৃত্যু মানে যথাসম্ভব বিনা উৎপীড়ন ও যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। নতুন এ আইনে বলা হয়েছে, ভেটেরিনারি কর্মকর্তার লিখিত নির্দেশনা বা তাঁর উপস্থিতি ছাড়া কোনো প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যু ঘটানো যাবে না। কোনো চিড়িয়াখানায় ব্যথাহীন মৃত্যু ঘটানো হলে সেই প্রাণীর বিস্তারিত পরিচিতি এবং ব্যথাহীন মৃত্যু ঘটানোর কারণসংবলিত প্রতিবেদন অনধিক সাত দিনের মধ্যে সরকার, মহাপরিচালক (প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর) ও জাতীয় চিড়িয়াখানায় পাঠাতে হবে।
বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে মাত্র দুটি চিড়িয়াখানা—একটি মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা, অপরটি রংপুর চিড়িয়াখানা। এর বাইরে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, খুলনা চিড়িয়াখানা ও নিঝুম দ্বীপ পার্ক রয়েছে। গাজীপুর ও কক্সবাজারে রয়েছে একটি করে সাফারি পার্ক। এ ছাড়া দেশে বেশ কিছু বেসরকারি চিড়িয়াখানা আছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাইরে থাকা এসব চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কে থাকা প্রাণী একই ধরনের সমস্যায় ভুগলে, সেগুলোর ব্যথাহীন মৃত্যু কার্যকর করা যাবে না।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন আইন হয়েছে। সে কারণে প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যু কার্যকরের ঘটনা এখনো ঘটেনি। তবে কীভাবে প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে, তা এখনো ততটা পরিষ্কার নয়।
জাতীয় চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা বলছেন, ‘যে প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যুর ঘটানো হবে, সেটিকে প্রথমে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অজ্ঞান করা হতে পারে। এরপর এমন কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে দেওয়া হলে প্রাণীটি মারা যাবে। সেটির কোনো ধরনের কষ্ট হবে না।’
রংপুর চিড়িয়াখানায় কোনো অসুস্থ প্রাণী নেই বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। আর মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় মোট ৩৮টি পশু-পাখি গড় আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। তবে এর মধ্যে একটি সিংহ দেড় বছর ধরে অসুস্থ।
কর্মকর্তারা জানান, বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভোগায় সিংহটিকে দেড় বছর আগে প্রদর্শনী থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটি এখন কম খাবার খায়। কখনো কখনো হাঁটতে গিয়ে ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারে না। মাঝেমধ্যে প্রাণীটির পাতলা পায়খানা হয়। এ পরিস্থিতিতে সিংহটিকে বোঝা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এটির ব্যথাহীন মৃত্যুর কথা ভাবছে।
মিরপুর চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, চিড়িয়াখানার একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। তবে সেটি পূর্ণাঙ্গ নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ করা হবে। সেই পূর্ণাঙ্গ কমিটির সভায় চিড়িয়াখানার অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এই সিংহের ব্যথাহীন মৃত্যুর বিষয়টি তোলা হবে। কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
‘সব চিড়িয়াখানা-সাফারি পার্কের জন্য একই বিধান দরকার’
কক্সবাজারের ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে এখন কোনো প্রাণী অসুস্থ নেই। তবে এই সাফারি পার্কে দেড় বছরের বেশি সময় অসুস্থতায় ভুগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘রাসেল’ নামের একটি সিংহ মারা যায়। অসুস্থতার একপর্যায়ে সিংহটিকে মুরগির মাংস ছোট ছোট টুকরা করে লাঠি দিয়ে খাওয়াতে হয়েছিল। সাফারি পার্কের কর্মকর্তারা মনে করেন, ব্যথাহীন মৃত্যুর বিধান থাকলে এই সিংহের ভোগান্তি কম হতো।
আইনে সব সরকারি ও বেসরকারি চিড়িয়াখানা এবং সাফারি পার্কের প্রাণীর জন্যই ব্যথাহীন মৃত্যুর বিধান থাকা প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের চিড়িয়াখানাগুলোর যে সক্ষমতা, তাতে সুস্থ প্রাণী সুস্থ রাখতেই হিমশিম খেতে হয়। সেখানে অসুস্থ প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন। অসুস্থ প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণ করতে গেলে সুস্থ প্রাণীগুলোই সংকটে পড়ে যায়। আইন করার সময় আলোচনায় হয়তো এই বিষয়গুলো আসেনি।’