হাত হারানো শিশু নাঈম: খোঁজ নেয়নি তারা, দেয়নি টাকাও

ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে এক হাত হারানো নাঈম হাসান নাহিদছবি: সংগৃহীত

রায়ের পর তারা আর খোঁজ নেয়নি। পড়ালেখার জন্য মাসে মাসে সাত হাজার টাকা করেও দেয়নি। এপ্রিল মাসের মধ্যে ১৫ লাখ টাকার যে ফিক্সড ডিপোজিট (এককালীন স্থায়ী আমানত) করে দিতে বলা হয়েছিল, তা–ও দেয়নি। এখন খরচ চালাতে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে।—কথাগুলো বলছিল ১৩ বছরের শিশু নাঈম হাসান নাহিদ। ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে চার বছর আগে শিশুটি তার ডান হাত হারায়।

নাঈমের হাত হারানোর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট হয়। এই রিট নিষ্পত্তি করে গত ৩১ জানুয়ারি বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সিদ্ধান্ত দেন।

হাইকোর্ট শিশু নাঈমের নামে ১৫ লাখ টাকা করে ১০ বছর মেয়াদে দুটি ফিক্সড ডিপোজিট করে দিতে ওয়ার্কশপের মালিককে নির্দেশ দেন। প্রথমটি চলতি বছরের এপ্রিলে ও দ্বিতীয়টি ডিসেম্বরের মধ্যে করতে বলা হয়।

একই সঙ্গে নাঈমের পড়ালেখার খরচ হিসেবে প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা করে তার ব্যাংক হিসাবে জমা দিতে মালিকপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত।

শিশু নাঈম কেমন আছে, তা জানতে গত বুধবার তার পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। কথা হয় শিশুটির সঙ্গেও।

পরিবার জানায়, নাঈম রাজধানীর ডেমরার করাতিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক এস এম আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নাঈম ছাত্র হিসেবে ভালো। চারটি শাখার মধ্যে একটির শিক্ষার্থী সে। ক্লাসে তার রোল ১৬।

তবে পাশাপাশি সম্প্রতি নাঈমকে কুমিল্লার সোনাকান্দা দারুল হুদা বহুমুখী কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়েছে বলে জানায় পরিবার।

মুঠোফোনে নাঈম প্রথম আলোকে বলে, দিন কয়েক হয়েছে সেখানে সে গেছে। সে যখন হাসপাতালে ছিল, তখন তার আব্বু বলেছিল, তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করাবে। তাই এখান তাকে ভর্তি করা হয়েছে।

ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে নাঈমের ডান হাত ড্রিল মেশিনে ঢুকে যায়। পরে শিশুটিকে বাঁচাতে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে তার ডান হাত বিচ্ছিন্ন করেন
ছবি: সংগৃহীত

সেদিন যা ঘটেছিল

নাঈমকে নিয়ে ২০২০ সালের ১ নভেম্বর প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল ‘ভৈরবে শিশুশ্রমের করুণ পরিণতি’।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, নাঈমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামে। তারা বাবা নিয়ামুল হোসেন আনোয়ার পেশায় জুতা ব্যবসায়ী। কর্মসূত্রে পরিবার নিয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বাস করছিলেন তিনি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে আনোয়ার কর্মহীন হয়ে পড়েন। সংসারের চাপ সামলাতে নাঈমকে তার মা–বাবা ভৈরবের একটি ওয়ার্কশপে কাজে দেন। ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে নাঈমের ডান হাত ড্রিল মেশিনে ঢুকে যায়। পরে শিশুটিকে বাঁচাতে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে তার ডান হাত বিচ্ছিন্ন করেন।

সে সময় নাঈমের পরিবার ভৈরবের কমলপুর এলাকার নূর বিল্ডিং নামের একটি ভবনে ভাড়া থাকত। ভবনটির মালিক এলাকার ইকবাল হোসেন ইয়াকুব। এলাকায় তাঁর ‘নূর ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামের ওয়ার্কশপ আছে। বাড়ির ভাড়াটে আনোয়ারের পরিবারের দুরবস্থা দেখে নাঈমকে ওয়ার্কশপে কাজ দেওয়ার প্রস্তাব দেন ইয়াকুব। তিনি বলেছিলেন, নাঈমকে দিয়ে কোনো ভারী কাজ করাবেন না। শুধু চা আনা আর ঝাড়পোছের মতো হালকা কাজ করাবেন। এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান নাঈমের বাবা আনোয়ার ও মা মনোয়ারা বেগম।

নাঈমের পরিবারের দাবি, শুরুর দুই মাস কথা রাখেন ইকবাল। নাঈমকে দিয়ে হালকা কাজই করাচ্ছিলেন তিনি। দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগ থেকে নাঈমকে ড্রিল মেশিন চালানোর কাজে যোগ দিতে বলেন ইকবাল। রাজি না হওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। পরে বাধ্য হয়ে নাঈম ড্রিল মেশিনের কাজে হাত লাগায়।

নাঈম হাসান নাহিদ
ছবি: সংগৃহীত

এখন টিকে থাকার লড়াই

নাঈমের হাত হারানোর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তার বাবা আনোয়ার হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৩১ জানুয়ারি হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দেন।

দুর্ঘটনার পর চিকিৎসার জন্য নাঈমকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল পরিবার। নাঈমের বাবা আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সাল থেকে তিনি পরিবার ঢাকার ডেমরার করাতিটোলা এলাকায় থাকছেন।

আরও দুই ছেলে আছে আনোয়ারের। একটি তৃতীয় শ্রেণিতে, অন্যটি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। মুঠোফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে পেটের দায়ে ছেলেকে ওয়ার্কশপে কাজে দিয়েছিলেন। সহায়-সম্বল যা ছিল, তা ছেলের চিকিৎসা ও মামলায় খরচ হয়েছে। তিনি এখন ঋণে জর্জরিত। ক্ষতিপূরণ না পেলে তাঁরা টিকবেন কীভাবে?

আপিল করবে মালিকপক্ষ

নাঈমের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত বুধবার ওয়ার্কশপটির মালিক ইকবালের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ারও ক্ষমতা নাই।’

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানান ইকবাল। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। রায় প্রকাশিত হলে আপিল করব।’

ইকবালের দাবি, শিশুটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সাড়া পাননি।

নাঈমের বাবা আনোয়ার বলেন, ‘এখন জুতার কারখানায় দৈনিক মজুরিতে কাজ করি। কাল বাজার করে ভাত খেতে পারব কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। তার ওপর ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ আছে। আর পারছি না। দিশাহারা হয়ে যাচ্ছি।’

আরও পড়ুন