ঘোষণাই সার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হল নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতেই

ছাত্রদের সাতটি হলে নিয়ম মেনে সর্বশেষ আসন বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০১৭ সালের জুনে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলছবি: সংগৃহীত

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবাসিক হলে আসন বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিল। ১৬ মাস পার হলেও কোনো শিক্ষার্থী আসন বরাদ্দ পাননি। এখনো হলের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে।

 বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হিসাবেই প্রায় ছয় হাজার ছাত্র হলে থাকতে দুই দফা আবেদন করেও আসন পাননি। কারণ, গত ছয় বছরে একবারও হলের আসন বরাদ্দ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার শর্তে আসন পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। 

নথি অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে হল রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে চালু আছে ১২টি। চালু থাকা হলের মধ্যে ছাত্রদের ৭টি, বাকি ৫টি ছাত্রীদের। ছাত্রীদের হলে বরাদ্দপ্রক্রিয়া চলমান। নিয়ম মেনে ছাত্রদের হলগুলোতে সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালে কর্তৃপক্ষ আসন বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দেয়। সেবার প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। এ ছাড়া ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর আবেদন করেন ১ হাজার ৬০ শিক্ষার্থী। আবেদন করলেও শিক্ষার্থীরা বৈধভাবে হলে উঠতে পারেননি।

১০ শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নাম লেখালে হলে থাকা যাচ্ছে। কিন্তু এতে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। তাই তাঁরা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছেন। 

হলে আসন বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, শাহ আমানতসহ কিছু হলে ইতিমধ্যে আসন বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে কোন হলে কতজন শিক্ষার্থীকে কবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা তিনি বিস্তারিত জানাতে পারেননি।

প্রক্টরের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শাহ আমানত হলের জ্যেষ্ঠ আবাসিক শিক্ষক মো. দিদারুল আলম চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের হলে এখনো আসন বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। একই কথা বলেন বাকি ছয়টি হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকেরা।

নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতে

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ছাত্রদের সাতটি হলে মোট কক্ষ রয়েছে ১ হাজার ৮৮টি। বরাদ্দ না থাকায় গত ছয় বছরে কক্ষ ও আসন দখলে নিতে অন্তত ২৪ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের নেতা-কর্মীরা। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ৭৩ জন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বর্তমানে কমিটি নেই। সাংবাদিক মারধর, চাঁদাবাজি ও বারবার সংঘর্ষের কারণে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তের পর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ পদধারী গুটিকয় নেতা ক্যাম্পাস ছাড়লেও বেশির ভাগ এখনো হলেই থাকছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতটি হলে নিয়ন্ত্রণ মূলত ৯ ছাত্রলীগ নেতার হাতে। শাহজালাল হলের একক নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগের উপপক্ষ সিক্সটি নাইন। এই উপপক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম ও শামসুজ্জামান চৌধুরী। আবার শাহ আমানত হল নিয়ন্ত্রণ করেন চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ারের নেতা সাবেক সহসভাপতি মির্জা খবির। আলাওল হলের নিয়ন্ত্রণ বিজয় উপপক্ষের নেতা সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ইলিয়াছের। সোহরাওয়ার্দী, শহীদ আবদুর রব ও এ এফ রহমান হল এককভাবে কোনো পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে না। এই তিন হলের নিয়ন্ত্রণে আছেন সাবেক সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী, আবু বকর, মইনুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব। তাঁদের কারও ছাত্রত্ব নেই।

এ ছাড়া মাস্টারদা সূর্য সেন হল নিয়ন্ত্রণ করে শাখা ছাত্রলীগের উপপক্ষ এপিটাফের নেতা-কর্মীরা। এ উপপক্ষের নেতৃত্ব দেন সাবেক নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক সাজ্জাদ আনাম। ১০ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তিনি দাবি করেন তাঁর এখনো ছাত্রত্ব আছে।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী, মির্জা খবির, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ইলিয়াছ, সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দিলে তাঁরা সব কক্ষ ছেড়ে দেবেন। তবে সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব বলেন, ‘হলগুলো ছাত্রলীগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছাত্ররাই হলে থাকবেন।’

হলের আসন বরাদ্দের এ সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বিকার বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম মেনে আসন বরাদ্দ দিতে প্রশাসনকেই শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে।