দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব নওগাঁ জেলার গণেশপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্রীমতী বণিতা খালকোর জীবন-গল্প।
আমি শ্রীমতী বণিতা খালকো, নওগাঁ জেলার গণেশপুর গ্রামে আমার জন্ম। মায়ের কথা আমার তেমন মনে পড়ে না। যখন আমার তিন বছর বয়স, মা তখন আগুনে পুড়ে মারা যান। এর পর থেকে আমাদের জীবন বদলাতে শুরু করে। বাবা আবার বিয়ে করলেন, সেই সংসারে দুই সন্তান হয়। আমাদের পরিবারে আমি ছিলাম ছয় বোনের মধ্যে পঞ্চম। বাবার নতুন বিয়ের পর রাতারাতি আমরা ছয় বোন সংসারের বোঝা হয়ে গেলাম। আমাদের পরিবারে তখন সব মিলিয়ে আটজন ছেলে-মেয়ে।
ওই দুর্দশার মধ্যে নানি এসে আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। মায়ের শূন্যতা পূরণে নানির কাছেই মাতৃস্নেহ পেলাম। তিনি হলেন আমার সবচেয়ে আপনজন। আমি তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু বাড়িতে নানির কথা খুব বেশি শোনা হতো না। আমার নানা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। তাঁর ছোট বউ সংসারের সব সিদ্ধান্ত নিতেন। আমাদের এই সংসারে এসে ওঠা তিনি মোটেই পছন্দ করলেন না। খাওয়া-পরা নিয়ে সব সময় কথা শুনতে হতো। এমন না যে নানার টাকাপয়সার অভাব ছিল। কিন্তু সতিনের নাতনিদের পেছনে সামান্য খরচই তাঁর কাছে অসহ্য মনে হতো।
ধান কাটার মৌসুমে আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে জমিতে পড়ে থাকা ধানের ছড়া কুড়িয়ে আনতাম। নানি সেগুলো জমিয়ে বিক্রি করে আমার জন্য জামাকাপড় কিনতেন।
যখন আমার ১০ বছর বয়স, বাবা তখন আমাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে এলেন। কারণ, আমি তখন বড় হয়ে উঠছিলাম আর আমার নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা বাড়ছিল। মানুষ হিসেবে বাবা খারাপ ছিলেন না। কিন্তু বাড়িতে সৎমায়ের সঙ্গে থাকার চেয়ে নানির সতিনের সংসারে থাকাও আমাদের জন্য ভালো ছিল।
বাড়িতে ফেরার পর থেকে আমাকে সব সময় সৎমায়ের গালমন্দ শুনতে হয়েছে। আমার আচার-আচরণ নাকি ‘ছেলেদের’ মতো। কারণ, আমি চাচাতো ভাইদের সাইকেল চালিয়ে বেড়াতাম, যা ছিল তাঁর ভীষণ অপছন্দের। বিভিন্ন অজুহাতে তিনি আমাকে কঠিন সব কাজ করতে বাধ্য করতেন।
একদিনের ঘটনা—আমার আঙুল কেটে গেল। হাতের ব্যথায় রাতে ভালো ঘুম হলো না। পরদিন ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হলো। এটা নিয়েই তিনি ভীষণ হুলুস্থুল করলেন। বললেন, আমি কোনো কাজ করি না, সারা দিন শুধু ঘুমিয়ে কাটাই। সেদিন আমাকে খাবার দেওয়া হলো না। অন্যদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে তিনি রান্নাঘরে তালা লাগিয়ে রাখলেন।
একসময় ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আমি অসাড় হয়ে পড়লাম। মনে হলো, আমি মরলেই বোধ হয় সবার জন্য ভালো হয়। দিনের সব কাজ শেষ করে বাড়ির যে কোণায় আমার মায়ের কবর, সেখানে গিয়ে বসলাম। জায়গাটা বেশ নির্জন। পাশেই ফসলের মাঠ। চাষিরা সবাই দুপুরের খাবার খেতে গেছে। মায়ের কবরের সামনে আমি একা।
আমার হাতে ফসলের পোকা মারার বিষের বোতল। সেই বিষের সঙ্গে পানি মিশিয়ে আমি গলায় ঢাললাম। একবার মনে হলো, বেশি পানি মিশিয়ে ফেলেছি, তাই কাজ হচ্ছে না। আবার মনে হলো, সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি, তাই হয়তো কাজ হতে দেরি হচ্ছে। আমি তখন পুরো বোতল উপুড় করে গলায় ঢেলে দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য, বিষ আমার শরীরে কোনো কাজ করল না।
অসহায় এতগুলো মেয়েকে ফেলে রেখে কেন মা এভাবে চলে গেল—এই আক্ষেপে মায়ের কবরের ওপর শুয়ে আমি চিৎকার করে কাঁদলাম। অনেকক্ষণ পর মন একটু হালকা হলো। কিন্তু ততক্ষণে শরীর প্রায় অবশ হয়ে এসেছে। আমার মনে হলো, সময় না হলে মৃত্যুও কাউকে গ্রহণ করে না। কয়েকবার বমি হলো। একটু সুস্থ বোধ করলাম।
অনেক কষ্টে বাড়িতে ফিরে আমার ছোট বোনকে সবকিছু জানালাম। তারপর সন্ধ্যা নামার আগেই দুজন পালিয়ে নানির বাড়িতে চলে গেলাম। ছোট বোনের কাছ থেকে আমার বিষ খাওয়ার কথা শুনে নানি খুব ভয় পেয়ে গেলেন। পরদিন থেকেই আমার বিয়ের জন্য খোঁজখবর করতে লাগলেন। নানির ধারণা ছিল, বড়লোকের ঘরে বিয়ে দিলে আমি সুখী হব না। তাই দরিদ্র পরিবারের একটি ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করলেন।
কয়েক বছর পেরোতেই আমি ছেলেসন্তানের মা হলাম। একটু ভালোভাবে জীবন কাটানোর আশায় ঢাকা শহরে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। শহরে এসে মাসখানেক নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি করলাম। একদিন আমার এক প্রতিবেশী আমাকে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির খবর জানায়। সেখানে নারীদের ড্রাইভিং শেখানো হয়। শুনেই আমার মনে খটকা লাগল, মেয়েরা গাড়ি চালাবে—তা কীভাবে সম্ভব?
আমার স্বামী উৎসাহ দিয়ে বলল, ‘প্রশিক্ষণ নিয়ে লাইসেন্সটা নিয়ে রাখো। তোমার তো কোনো খরচ লাগবে না। নতুন একটা দক্ষতা শিখতে পারলে কাজেও তো লাগতে পারে।’ আমাকে রাজি করাতে তার দুই মাস লেগেছিল। স্বামীর একটা কথা আমার মনে ভীষণ দাগ কেটেছিল। সে বলেছিল, ‘আমার কখনো কিছু হয়ে গেলে, তুমি অন্তত নিজের মতো চলতে পারবে।’
প্রথমবার ট্রেনিং সেন্টারে যাওয়ার স্মৃতি কখনোই ভুলব না। কী ব্যস্ত ঢাকার রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার! চারপাশ দিয়ে শত শত বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ভীষণ গতিতে ছুটছে। আমার মনে হলো, কোনো দিনও আমি এসবের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালাতে পারব না। আমার স্বামী সাহস দিয়ে বলল, ‘চেষ্টা করে দেখো’। তারপর আমি ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হলাম। খবরটা সে-ই প্রথম আমাদের বাড়িতে জানাল।
তিন মাস ট্রেনিংয়ের পর আমি লাইসেন্স পেলাম। এরপর ড্রাইভার হিসেবে ব্র্যাকে আমার চাকরি হলো। আমার স্বামী গর্ব করে বলল, ‘আমি যা পারিনি, তুমি তা করে দেখিয়েছ।’ এরপর থেকে সে-ও ড্রাইভিং শেখা শুরু করল। চাকরি পাওয়ার খবর পেয়ে আমার নানি ভীষণ খুশি হলেন।
শুরুতে গ্রামের কেউই তেমন বিশ্বাস করত না। তারা বলত, ‘ছেলেরাই গাড়ি চালাতে হিমশিম খায় আর তুমি চালাবে গাড়ি। ঢাকায় থাকো বলে যা বলবে তা-ই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে?’
চাকরির নিয়মানুযায়ী ব্র্যাক থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা তথ্য যাচাই করতে আমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁরা আমার ছবি দেখিয়ে নানা প্রশ্ন জানতে চেয়েছিলেন। সেই ঘটনার পর সবাই বুঝল যে আমি সত্যি বলেছি। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকেই তাদের মেয়েদের কাছে আমার গল্প করত, যাতে তারা আমার মতো হয়। আমিও তাদের অনেককে চাকরি পেতে সহায়তা করেছি। চাকরি পাওয়ার পরও বেশ কয়েকবার আমি ইন্টারভিউ বোর্ডে বসেছি—পরীক্ষা দিতে নয়, অন্যদের পরীক্ষা নিতে।
রাস্তায় গাড়ি চালানো সহজ কাজ নয়। আশপাশের গাড়ি আমার গাড়িকে চাপিয়ে দিয়ে জায়গা নিতে চাইত, অন্য লেন থেকে এসে আমার লেনে ঢুকে পড়ত, না পারলে চোখ রাঙাত। অনেকে আবার আমার গাড়িতে ওঠার আগে প্রশ্ন করত, অন্য কোনো ড্রাইভার ছিল না! অবশ্য ব্র্যাকের কেউ কখনো আমাকে এমন প্রশ্ন করেনি।
মনে আছে, প্রথমবার আমি যখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গাড়ি চালিয়ে প্রবেশ করছিলাম, গেটে দায়িত্বরতরা আমাকে স্যালুট দিয়েছিলেন। তাঁরা হয়তো নিয়ম মানার জন্য এটা করেছিলেন, কিন্তু আমার কাছে তা ছিল বিরাট সম্মানের। মনে হয়েছিল, আমি সত্যিই ভালো কিছু করছি।
বর্তমানে আমাদের দুই ছেলে। তারা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে আমি ওদের গাড়িতে করে ঘুরতে নিয়ে যাই। তারা ভীষণ খুশি হয়। আমাকে নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। গ্রামে গেলে তারা তাদের বন্ধুদের গর্ব করে বলে, ‘জানো, আমার মা গাড়ি চালাতে পারে।’
জীবনে সংগ্রামের অনেকটা পথ পেরিয়ে আমি এখন একটা কথা প্রবলভাবে বিশ্বাস করি, মনপ্রাণ দিয়ে কিছু অর্জন করতে চাইলে সফলতা আসবেই।