‘শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার যেন সুনামির মতো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে’

শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পেশাজীবীদেরও সচেতনতা দরকার।

দেশে শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার যেন সুনামির মতো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অস্ত্রোপচার বাড়ছে। দুটি শিশু জন্মের একটি হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। এতে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বাড়ছে স্বাস্থ্য ব্যয়।

গতকাল শুক্রবার পেশাজীবী চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) ৩১তম আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের একটি অধিবেশনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হওয়া দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলন আজ শনিবার শেষ হবে। সম্মেলনে এক হাজারের বেশি দেশি–বিদেশি স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিশেষজ্ঞ অংশ নিচ্ছেন।

গতকাল বিকেলে শিশু জন্মে অস্ত্রোপচারবিষয়ক অধিবেশনে ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বলেন, ‘২০০৪ সালে ৪ শতাংশ শিশুর জন্ম হতো অস্ত্রোপচারে। ২০১৮ সালে তা ৮ গুণের বেশি বেড়ে হলো ৩৪ শতাংশ। আমাদের চোখের সামনে এটা হয়েছে। সেই হার বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ৪৫ শতাংশ। শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার যেন সুনামির মতো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।’

আরও পড়ুন

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার বেশি হচ্ছে উল্লেখ করে ফেরদৌসি বেগম বলেন, সমাজের দরিদ্র পরিবারের চেয়ে ধনী পরিবারে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম প্রায় তিন গুণ বেশি। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, এমন মায়েদের চেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা মায়েদের মধ্যে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম দুই গুণ বেশি।

দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বলেন, অস্ত্রোপচার জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। তবে সব ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন নেই।

শিশু জন্মে অস্ত্রোপচারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিক নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ভারতের অদিতি হাসপাতালের পরিচালক ও প্রসূতি রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক চারমিলা এ্যাভো। তিনি বলেন, সাধারণভাবে অস্ত্রোপচারের পরে রক্তক্ষরণ বেশি হয়, সংক্রমণ বাড়ে, মায়ের সুস্থ হয়ে উঠতে সময় বেশি লাগে এবং নবজাতককে মায়ের দুধ খাওয়ানোয় বিলম্ব হয়। মায়ের অস্ত্রোপচারজনিত জটিলতা দেখা দেয়। স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় অস্ত্রোপচারে মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। তিনি বিভিন্ন দেশের গবেষণার তথ্য এসব ঝুঁকির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন।

একই সঙ্গে একাধিক আলোচক শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার কমানোর কী উপায়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কোন ধরনের কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ কী উদ্যোগ নিয়েছে, তা বর্ণনা করার সময় অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম বলেন, ২০১৯ সালে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টির ওপর নজরদারির জন্য একটি কমিটি তৈরি করেছে। চিকিৎসা ও মানুষকে সচেতন করার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। একাধিক গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল দেশের ১০টি জেলায় এই বিষয়ে তথ্য–উপাত্তের নজরদারি করছে। সরকারের পক্ষে ওজিএসবি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

২০০৪ সালে ৪ শতাংশ শিশুর জন্ম হতো অস্ত্রোপচারে। ২০১৮ সালে তা ৮ গুণের বেশি বেড়ে হলো ৩৪ শতাংশ। আমাদের চোখের সামনে এটা হয়েছে। সেই হার বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ৪৫ শতাংশ।
অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম, সভাপতি, ওজিএসবি

শিশু জন্মে অস্ত্রোপচারবিষয়ক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন শ্রীলঙ্কার প্রসূতি রোগবিশেষজ্ঞ রোহানা হাথথোথুয়া, ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রওশন আরা বেগম ও ভারতের প্রসূতি রোগবিশেষজ্ঞ শ্যাম দেশাই।

রোহানা হাথথোথুয়া বলেন, অস্ত্রোপচার বৃদ্ধির কারণে মাতৃমৃত্যু কমেছে, এমনটি কোথাও দেখা যায়নি। শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার বেড়ে যাওয়ার দায় প্রসূতি রোগবিশেষজ্ঞদেরও আছে।

অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন, অস্ত্রোপচার কমাতে যে ধরনের উদ্যোগ সফল হয়েছে বলে জানা গেছে, সেগুলো অনুসরণ করা দরকার। তিনি আরও বলেন, অস্ত্রোপচারের কারণে ফিস্টুলা (প্রস্রাবে নিয়ন্ত্রণ না থাকা) রোগের পরিমাণ বেড়ে গেছে।

এর আগে প্রসবকালে রক্তক্ষরণ প্রতিরোধবিষয়ক অধিবেশনে বলা হয়, জন্মের পরপরই নবজাতককে যেন মাকে খুঁজতে না হয়। কারণ, অনেক সময় দেখা যায়, অস্ত্রোপচারসহ নানা কারণে মা ও নবজাতককে আলাদা রাখা হয়। জন্মের পরপরই নবজাতককে মায়ের সংস্পর্শে রাখতে হবে। এটা মা ও নবজাতক উভয়ের জন্য দরকার। আরেকটি অধিবেশনে বারবার গর্ভ কেন নষ্ট হয় এবং তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা হয়।

গতকাল সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। আজ সম্মেলনের শেষ দিনে বিভিন্ন বিষয়ে কমপক্ষে ১৫টি পৃথক অধিবেশন হওয়ার কথা আছে।