নারী-পুরুষ সমতা কার্যকর হচ্ছে না: সিডও দিবসে বক্তারা

নারী
প্রতীকী ছবি

৩৮ বছর আগে সরকার জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) অনুমোদন করেছে। কিন্তু সনদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারায় এখনো আপত্তি প্রত্যাহার করেনি সরকার। জাতিসংঘ সিডও কমিটির কাছে সরকারের জমা দেওয়া প্রতিবেদনে আপত্তি প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন, বিবেচনাধীন বললেও অষ্টম প্রতিবেদন থেকে এ ধরনের কথাও বাদ দিয়েছে। ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বলছে এসব পরিবর্তন গ্রহণে সরকার এখনো প্রস্তুত নয়।

শনিবার আন্তর্জাতিক সিডও দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত ‘জাতিসংঘ সিডও কমিটির সমাপনী মন্তব্য (২০১৬): বাস্তবায়ন পর্যালোচনা’বিষয়ক মতবিনিময় সভায় আলোচকেরা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন না দেওয়ায় সংবিধানে নারী–পুরুষে যে সমতার কথা বলা হয়েছে, তা–ও কার্যকর হচ্ছে না।

২০১৯ সালে সিডও কমিটিকে সরকারের নবম প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। তবে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে সেই সময়সীমা শিথিল করা হয়। নবম প্রতিবেদন দ্রুত তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এ প্রতিবেদনে সরকার দুটি ধারা থেকে আপত্তি তুলে নেওয়ার কথা জানাবে, সে প্রত্যাশা করেন মতবিনিময় সভার আলোচকেরা। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে সিডও কমিটির কাছে সম্পূরক প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সিডও সনদ কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এটি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে। শুরুতে চারটি ধারার ওপর আপত্তি ছিল। পরে ২ ও ১৬(১)(গ) ধারার ওপর আপত্তি রেখে বাকি দুটি থেকে তুলে নেওয়া হয়। সিডও সনদের ২ ধারায় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে আইনের সংস্কার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং ১৬(১)(গ) ধারায় বিয়ে ও পারিবারিক আইনে সম-অধিকারের কথা বলা হয়।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মহিলা পরিষদের কার্যালয়ে আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সিডও সনদ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সম্পূরক হিসেবে স্বীকৃত হলেও এ সনদ বাস্তবায়নে এখনো চ্যালেঞ্জ আছে।

একদিকে সরকার নারীবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, আবার সিডও সনদের ধারা থেকে আপত্তি তুলতে পিছিয়ে যাচ্ছে। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে এজেন্সিগুলো কাজ করছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া জরুরি।

সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইউএন উইমেন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ গীতাঞ্জলি সিং বলেন, ২০২২ সালের বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন অনুসারে এখনো সমতা প্রতিষ্ঠায় নানা বৈষম্য আছে। করোনাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। তিনি নারী–পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জোর দেন।

আলোচনায় জাতিসংঘ সিডও কমিটির সাবেক সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ৩৭ বছরে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু কোনো সরকারই সিডও সনদের দুটো ধারা থেকে আপত্তি তুলে নিতে উদ্যোগ নেয়নি। বিভিন্ন সরকার একই ভূমিকা পালন করেছে। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৯টি দেশ সনদটিতে অনুমোদন দিয়েছে।

আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া, কুয়েত, মালদ্বীপসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন দিয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলেও সিডও সনদে পূর্ণ অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন।

সমকাল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সনদের দুটি ধারা থেকে আপত্তি তুলতে এখনো বলতে হচ্ছে সমাজ প্রস্তুত নয়, ধর্মীয় নেতারা সম্মত নন।

দেশে বর্তমানে নারীর ছোট, মধ্য ও লম্বা পোশাক নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সনদের দুটি ধারা থেকে আপত্তি তুলতে সরকারের সঙ্গে দেনদরবারে ফলটা বের করে আনতে কোথায় বেগ পেতে হচ্ছে। সিডও সনদ বাস্তবায়নে তিনি সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, কয়েকটি পকেট ছাড়া রাজনৈতিকভাবে নারীদের অংশগ্রহণের জায়গাটা কোথায়? সরকারের ভাষায় সিডও সনদের দুটি ধারা থেকে আপত্তি তুলতে যে ব্যবস্থা নিতে হবে তা মানতে সমাজ প্রস্তুত নয়; তাহলে সমাজ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার জন্য প্রস্তুত কি না, সে প্রশ্ন করেন তিনি।

সভায় স্বাগত বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সরকার সিডও সনদের ধারা দুটি থেকে আপত্তি তুলে নিচ্ছে না, আর নারীবিরোধী মৌলবাদী শক্তি এর সুযোগ গ্রহণ করছে। বৈবাহিক ক্ষেত্রে সমতা না থাকলে পারিবারিক সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

সভায় বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্তর্জাতিক সম্পাদক দেবাহুতি চক্রবর্তী, কেয়ার বাংলাদেশের উইমেন অ্যান্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক হোমায়রা আজিজ, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।

সভার শুরুতে জাতিসংঘ সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খানের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা। সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম।