স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন নিয়ে যে কারণে আবার লিখছি

বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা। আজ বিকেলে চট্টগ্রামের পটিয়ার কচুয়াইয়ের চা–বাগান এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

জমজমাট নানা ইস্যু চারদিকে। তার মধ্যে লেখার মতো ঘটনা হিসেবে এটা মোটেই ‘আকর্ষণীয়’ বাছাই নয়। একটা স্কুল প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চবিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, এ নিয়ে বিশেষ কী আর লেখা হতে পারে! এ ছাড়া ঘটনাস্থলে আমি উপস্থিতও নেই। অথচ দূর থেকে মুহূর্তটা উপভোগ করছি। ভালো লাগছে। এই প্রচেষ্টার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক, যদি আমাদের অনুসন্ধানী মন এ রকম উদ্যোগ থেকে আদৌ কিছু শিখতে-বুঝতে চায়।

যেভাবে শুরু

স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতনের অবস্থান চট্টগ্রামের কচুয়াই। ২০১৯-এর ডিসেম্বরেও এই স্কুল নিয়ে আরেকবার লিখেছিলাম। জায়গাটা পটিয়া উপজেলার প্রান্তিক ও পরিত্যক্ত একটি চা-বাগান। ধীরে ধীরে এখানেই গড়ে উঠেছে জাতীয়ভাবে মনোযোগ পাওয়ার মতো এক শিক্ষা-নিরীক্ষা, স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন।

প্রথমে পরিত্যক্ত চা-বাগিচার শিশুরা উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য থাকলেও এখন আশপাশের বাঙালি শিশু-কিশোরেরাও পড়ছে এখানে। বলা যায়, বাঙালিদের সংখ্যাই বেশি এখন-৬০-৭০ ভাগ।

চট্টগ্রাম থেকে কচুয়াইয়ের দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার হবে। কেবল দূরত্বে দূরবর্তী নয়, সামাজিক-অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও কচুইয়ারের কিছু মানুষ আমাদের তথাকথিত ‘মূলধারা’ থেকে বেশ দূরে। এখানে থাকে আদিকালের চা-বাগিচার একদল মানুষ। যত দূর জানা যায়, বাকুড়া থেকে এখানে এসেছিল তারা। কীভাবে কাদের হাত ধরে এসেছিল, সেসব স্মৃতিকথার অনেকখানি মূলধারার ইতিহাসে বিলীন হয়ে গেছে।

স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। আজ বিকেলে চট্টগ্রামের পটিয়ার কচুয়াইয়ের চা-বাগান এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

চার দশকের বেশি আগে এখানকার চা-বাগিচাও বন্ধ হয়ে গেছে। তখন পরিত্যক্ত হয় এসব ‘কাজের মানুষ’ও। শিক্ষার অধিকার তাদের কাছে বহুকাল স্বপ্নের মতো একটা ব্যাপার ছিল।

পাহাড়ি ধাঁচের এই এলাকায় যোগাযোগ ছিল দুরূহ। আছে বিস্তর দারিদ্র্যও। আশপাশে স্কুলও ছিল না। এখনো এসব সমস্যা আছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। যার সূত্রপাত ১৩-১৪ বছর আগে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী রাজনীতিমনা তরুণ চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন কচুইয়ারের এসব মানুষের মধ্যে কাজ করতে। দেড় দশক হলো সেই যুক্ততার।

প্রথমে পরিত্যক্ত চা-বাগিচার শিশুরা উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য থাকলেও এখন আশপাশের বাঙালি শিশু-কিশোরেরাও পড়ছে এখানে। বলা যায়, বাঙালিদের সংখ্যাই বেশি এখন—৬০-৭০ ভাগ।

ইতিমধ্যে স্কুল গড়ার উদ্যোগ ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক আদলও নিয়েছে। অনেক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে এখন। তার চেয়ে বড় কথা, জন্ম হয়েছে শিশু ও সমাজবান্ধব বিকল্প এক শিক্ষাচিন্তার।

কেন স্বপ্ননগর নিরীক্ষা আলাদা কিছু

সব সমাজেই একদল মানুষ থাকে, যারা কথা বলতে ভালোবাসে। আরেক দল বেছে নেয় চুপচাপ কিছু নিরীক্ষার পথ। কচুইয়ারের স্বপ্ননগর দ্বিতীয় ধারার ল্যাব। শুরুতে ছিলেন ধ্রুবজ্যোতি হোড়, সুজা আল-মামুন, নাসিমা সিরাজি, ইশতিয়াক মাহমুদ, নিলয় দাশ, অনিকেত চৌধুরী, সৈয়দা মাসুকরা জাহান। সমন্বয়কারী হিসেবে পুরোনো লোকজন আছেন এখনো। ধীরে ধীরে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ছে। এখন তাঁরা ১২ জন হলেন। স্কুলের কাজে শক্তি জোগাতে সমর্থক ফোরাম বলে একটি টিমও সচেষ্ট আছে। পুরো টিমে সাম্প্রতিক বড় এক সংযুক্তি সাইফুজ্জামান সাকন। সংগঠক হিসেবে যাঁর বেশ সুনাম।

বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা। আজ বিকেলে চট্টগ্রামের পটিয়ার কচুয়াইয়ের চা-বাগান এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

স্বপ্ননগরের শিক্ষক-সমর্থক-সমন্বয়কারী—সবাই চট্টগ্রাম, খুলনা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তেন বিভিন্ন সময়। পেশাও বিবিধ তাঁদের: শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, আইনজীবী, সাংবাদিকতাসহ অন্যান্য। ছাত্রত্বকালে অধিকাংশই শিক্ষা অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য কাজ করতেন। ওই সময়কার রূপান্তরবাদী শিক্ষাচিন্তারই নিরীক্ষা স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন।

এখানে লেকচারভিত্তিক প্রচলিত স্টাইল থেকে শ্রেণিকক্ষগুলোকে মুক্ত করার প্রবল চেষ্টা চলছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ থেকেও মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে। প্রকৃতি-পরিবেশে এবং রং-রূপের বৈচিত্র্য জানাবোঝার জন্য ইট-সিমেন্টের অবকাঠামোর বাইরে বাচ্চাদের প্রলুব্ধ করা হয় বেশি।

শ্রেণিকক্ষে মূলত জোর দেওয়া হয় গণিত ও ভাষাশিক্ষা। এ ছাড়া খেলা ও সমস্যা-সমাধানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। পুরো কার্যক্রমকে আনন্দদায়ক করে তুলতে আলোকচিত্র, থিয়েটার এবং সুরের চর্চাও আছে। স্কুলসহ আশপাশের এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বে অভ্যস্ত করা হয়েছে শিক্ষার্থীদেরই। স্কুল চত্বরের কৃষিতেও তারা শামিল থাকে।

এ রকম সব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কীভাবে সাহায্য করা হচ্ছে, এ বিষয়ে মাঝেমধ্যে এখানে শিক্ষকদের আলাদা ক্লাস হয়। সেখানে পথ খোঁজা হয় শিক্ষাসম্পর্ককে ক্রমে কীভাবে ভয়মুক্ত ও আধিপত্যমুক্ত করা যায়, তার ওপর।

প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এবার নতুন যাত্রা

দরিদ্র এলাকা বলে কচুয়াইয়ে শিশুদের দুপুরের খাওয়াটা জরুরি এক বিষয় ছিল। খাবারের পরিতৃপ্তি শিশুর মনোযোগের এক বড় শর্ত। এ কারণে স্বপ্ননগরে স্কুল টিফিনের মেনু তৈরি হচ্ছে বেশ ভেবেচিন্তে। সমাজের নানাজনের উদার সহযোগিতায় যে এসব হচ্ছে, সেটা বলাই বাহুল্য। তবে উদ্যোক্তাদের শিক্ষাচিন্তার দৃঢ়তাই বন্ধু, সমর্থক, সমন্বয়কদের আর্থিক সহযোগিতাকে গতি দিচ্ছে।

এ রকম সহায়তাতেই তিন-চার কিলোমিটার দূরের শিশুদের আনা-নেওয়ায় যুক্ত করা হয়েছে একটা হিউম্যান হলার। শিক্ষকদের আসা-যাওয়াতেও কাজে লাগছে এটা।

দেড় দশকের পথচলায় এখানে একটা বড় সমস্যা ছিল, পঞ্চম শ্রেণির পর বাচ্চাদের পুরো দলকে শিক্ষায় ধরে রাখতে কিছু করা যাচ্ছিল না। দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ এবং হাইস্কুল না থাকায় প্রাথমিকের পরই অধিকাংশ শিশুর শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যেত এত দিন।

সেই সমস্যা এবার কাটবে। এবার থেকে বিদ্যাপীঠ ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ধাপে ধাপে ওপরের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো আজ শুক্রবার। কচুয়াইয়ে এ কারণে দিনভর উৎসবের আবহ।

দূর থেকে স্বপ্ননগরকে অভিবাদন। সেই সঙ্গে অভিনন্দন স্কুলের সেই তিন শিক্ষার্থীকেও, যাঁরা এখন থেকে যাত্রা করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে শিক্ষার্থী হতে পারল। এ রকম এক শিক্ষার্থী রেখা দাশকে নিয়ে প্রথম আলোও একদা লিখেছিল—যা তাঁকে খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে ভর্তি হতে সহায়তা করেছে।

কচুয়াইয়ে রেখা বা তাঁর পরের অন্যরা কীভাবে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ রূপান্তরে শামিল হচ্ছেন, সেটা প্রকৃতই এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগ্রহীরা কচুয়াইয়ে গিয়ে দেখতে পারেন—সামাজিক উদ্যোগ কীভাবে সমাজকে ভেতর থেকে বদলে দিতে পারে এবং কীভাবে নতুন সমাজের জন্য নতুন মানুষ গড়ার কাজটি এগোনো যায়।

আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক