চীনা ঋণের ১৭ প্রকল্পে গতি নেই

১৭টি প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে ১১ প্রকল্পের দিকে। বাকি ৬টির ভাগ্য অনিশ্চিত।

চীনের অর্থায়নে প্রথম টানেলের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সমঝোতা হয় ২০১৬ সালের অক্টোবরে; দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। সাত বছর পর গত ২৮ অক্টোবর সুড়ঙ্গপথটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

কেবল কর্ণফুলী টানেল নয়, সি চিন পিং ঢাকা সফরের সময় অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতের মোট ২৭টি প্রকল্পে দুই হাজার কোটি ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা।

তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত সাত বছরে সব মিলিয়ে ১০টি প্রকল্পে চীনের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। এর মধ্যে ৩ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ৭টি চলমান। এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৪৬ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা।

চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে আসেন সাত বছর আগে। ওই সময়ে নেওয়া সব প্রকল্পের প্রাসঙ্গিকতা এখন নেই। তখন হয়তো প্রকল্পগুলোর প্রয়োজন ছিল। এখন অগ্রাধিকারের পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অগ্রাধিকার ঠিক হয়েছে।
শরিফা খান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব

নথি ঘেঁটে ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চীনের অর্থায়নে বাকি যে ১৭টি প্রকল্প হওয়ার কথা, সেগুলো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কোনোটিরই কাজ এখনো শুরু হয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসব প্রকল্পে ধীরে চলার কৌশল নেওয়া হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে ১১ প্রকল্পের দিকে। বাকি ৬টির ভাগ্য অনিশ্চিত।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান প্রথম আলোকে বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে আসেন সাত বছর আগে। ওই সময়ে নেওয়া সব প্রকল্পের প্রাসঙ্গিকতা এখন নেই। তখন হয়তো প্রকল্পগুলোর প্রয়োজন ছিল। এখন অগ্রাধিকারের পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অগ্রাধিকার ঠিক হয়েছে।

আরও পড়ুন

ইআরডির কর্মকর্তারা এ-ও বলছেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর চীন থেকে নমনীয় শর্তে ঋণ পাবে না। সুতরাং হাতে সময় আছে তিন বছর। তাই এ সময়ের মধ্যে নমনীয় ঋণ নিয়ে বাকি প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করার কথা বলছেন তাঁরা। এ নিয়ে গত বছর অর্থমন্ত্রীকে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল ইআরডি থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, অবকাঠামো প্রকল্প দিয়ে শুধু যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, এমনটি ভাবা ঠিক হবে না। ওই সব এলাকায় বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে চীনের ঋণের টাকা ওঠানো সম্ভব হবে।

চীনা ঋণের ১৭ প্রকল্পে গতি কমার আরেকটি কারণ জানা গেছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে চীনা ঋণের প্রকল্পে সরাসরি তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে দরপত্র ছাড়া কাজ দেওয়া হতো। চীন সরকারই ঠিকাদার ঠিক করত।

১১ প্রকল্পে অগ্রাধিকার

চীনা দূতাবাসে গত বছর একটি চিঠি দেয় ইআরডি। চিঠিতে ১১ প্রকল্পের তালিকা দিয়ে বলা হয়, সরকার এসব প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকা বাকি ছয় প্রকল্পের বিষয়ে চিঠিতে কিছু বলা হয়নি। অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনা, তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, আখাউড়া থেকে সিলেট সেকশন পর্যন্ত রেললাইনকে মিটারগেজ থেকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর, ডিজিটাল কানেকটিভিটি স্থাপন এবং পৌরসভাগুলোর জন্য পানি সরবরাহ প্রকল্প। ১১ প্রকল্পে চীন থেকে ৫০২ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। যদিও এর একটিরও কাজ এখনো শুরু হয়নি।

আরও পড়ুন

চীনা ঋণের ১৭ প্রকল্পে গতি কমার আরেকটি কারণ জানা গেছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে চীনা ঋণের প্রকল্পে সরাসরি তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে দরপত্র ছাড়া কাজ দেওয়া হতো। চীন সরকারই ঠিকাদার ঠিক করত। এতে কমিশন-বাণিজ্যের সুযোগ ছিল। তবে ২০১৭ সালে নতুন একটি নীতিমালা জারি করে ইআরডি। তাতে চীনা ঋণের নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়।

নতুন নীতিমালায় বলা হয়, সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে (এলটিএম) ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। এই পদ্ধতিতে দরপত্রে কেবল চীনা ঠিকাদারেরা অংশ নেবেন। দরপত্রে অংশ নেওয়া একাধিক ঠিকাদারের মধ্যে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্তভাবে বাছাই করা হবে। এ নীতিমালা জারির পরই চীনা ঋণের প্রকল্প নিয়ে আলোচনার গতি কমে যায়।

চীন শুধু অবকাঠামোতে নয়, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে। এর মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তেমনি মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে অবদান রাখছে।
আল মামুন মৃধা, বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ সম্পাদক

বাদ পড়ল ৫ প্রকল্প

চীনের টাকায় হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে পাঁচটি প্রকল্প বাদ দেয় সরকার। চীনা দূতাবাসে চিঠি দিয়ে এসব প্রকল্প বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়। প্রকল্পগুলো হচ্ছে ঢাকা-সিলেট চার লেন মহাসড়ক, পাটকল আধুনিকায়ন, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ৩৫০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রিপেইড মিটার এবং দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি সম্প্রসারণ প্রকল্প।

ইআরডির সূত্র বলছে, ঢাকা সিলেট মহাসড়ক প্রকল্পটি প্রথমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) টাকায় হওয়ার কথা ছিল। পরে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর তদবিরে এডিবিকে বাদ দিয়ে চীন থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চার লেন সড়কটির কাজ দেওয়া হয় চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে।

কিন্তু তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামকে এক লাখ ডলার (৮২ লাখ টাকা) ঘুষ সাধার অভিযোগ ওঠে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে। শেষে চীনের ঋণ বাতিল করে আবার এডিবি থেকে ঋণ নেওয়া হয়।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সাগরতলে পাইপলাইন দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হবে। এর মাধ্যমে জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় নতুন দিক উন্মোচিত হবে।
মো. লোকমান, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

সমাপ্ত তিন, চলমান সাত

চীনের অর্থায়নে গত সাত বছরে তিন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। সেগুলো হলো কর্ণফুলী টানেল, রাজধানীর দাশেরকান্দিতে পয়ঃশোধনাগার প্ল্যান্ট এবং ফোর টায়ার জাতীয় ডেটা সেন্টার স্থাপন।

অন্যদিকে চলমান সাত প্রকল্প হচ্ছে পদ্মা রেল সংযোগ, চট্টগ্রামের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম, ঢাকা আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পিজিসিবির আওতায় বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন, ডিপিডিসির আওতায় বিদ্যুতের বিতরণব্যবস্থার উন্নয়ন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং রাজশাহী ওয়াসার ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ প্রকল্প।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাগরের তলদেশ দিয়ে তেল সরবরাহের জন্য নির্মিত পাইপলাইন এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। এটি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম প্রকল্প নামে পরিচিত। ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সাগরতলে পাইপলাইন দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হবে। এর মাধ্যমে জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় নতুন দিক উন্মোচিত হবে।

অবকাঠামো প্রকল্পে শুধু টোল আদায় বা পরিবহন দিয়ে ঋণের টাকা উঠবে না। জোর দিতে হবে বিনিয়োগ, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্যের ওপর। ত্রিমাত্রিক সংশ্লেষ ঘটাতে পারলে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থাও তৈরি হবে। তিনি বলেন, চীনের অর্থায়নে নতুন করে যেসব প্রকল্প নেওয়া হবে, তা যেন ভালো করে যাচাই-বাছাই করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, এমন প্রকল্প নেওয়া উচিত।
মোস্তাফিজুর রহমান, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)

এ ছাড়া ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেল চলাচল চালু হয় গত ১০ অক্টোবর। তবে উদ্বোধন হলেও এ রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হতে আরও সময় লাগবে। আগামী বছর রেলপথের বাকি অংশ ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত চালু হওয়ার কথা রয়েছে।

এর আগে গত জুলাইয়ে রাজধানীর আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে চালু হয় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধনাগারের কার্যক্রম। ঋণের বাইরে অনুদানের টাকায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আটটি মৈত্রী সেতু নির্মাণ করেছে চীন। সর্বশেষ গত বছর পিরোজপুরের কঁচা নদীর ওপর অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু চালু হয়।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, চীন শুধু অবকাঠামোতে নয়, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে। এর মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তেমনি মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে অবদান রাখছে।

চীনের সঙ্গে বাণিজ্য

এদিকে চীন থেকে বরাবরই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। গত ১০ বছরে দেশটি থেকে আমদানি ৩ গুণ বেড়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর বাংলাদেশ ৭ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। তার মধ্যে চীন থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য এসেছে। এর আগের বছর দেশটি থেকে আমদানি করা হয়েছিল ১ হাজার ২৯৩ কোটি ডলারের পণ্য। তার মানে এক বছরের ব্যবধানে চীনা পণ্যের আমদানি বেড়েছে ৬৪২ কোটি ডলারের।

চীন থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় ৬৮ কোটি ডলার, যা দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানির মাত্র সাড়ে তিন শতাংশের সমান। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।

চীনা প্রকল্প নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অবকাঠামো প্রকল্পে শুধু টোল আদায় বা পরিবহন দিয়ে ঋণের টাকা উঠবে না। জোর দিতে হবে বিনিয়োগ, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্যের ওপর। ত্রিমাত্রিক সংশ্লেষ ঘটাতে পারলে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থাও তৈরি হবে। তিনি বলেন, চীনের অর্থায়নে নতুন করে যেসব প্রকল্প নেওয়া হবে, তা যেন ভালো করে যাচাই-বাছাই করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, এমন প্রকল্প নেওয়া উচিত।