জানতে চেয়েছে নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি

  • নির্বাচন সামনে রেখে একটি চক্র পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চাইছে—প্রতিনিধিদলকে সরকার।

  • বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে যে মজুরি ধরা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়, ভাষ্য নাগরিক সমাজের।

বাংলাদেশ সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন
ছবি: পিআইডি

সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শ্রমবিষয়ক প্রতিনিধিদল সরকারের কাছে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছে ইইউ প্রতিনিধিদল। বৈঠকে তাঁরা এসব বিষয়ে জানতে চান বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ সফরের তৃতীয় দিন ইইউর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা প্যাম্পালোনির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলটি শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গেও দেখা করেছে। পাশাপাশি প্রতিনিধিদল ঢাকায় কূটনৈতিক মিশন, শ্রমিকনেতা, নাগরিক সমাজ এবং বিজিএমইএ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করে।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ইইউ প্রতিনিধিদলকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।

মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রতিনিধিদলকে জানান, পোশাক কারখানায় অস্থিরতার জন্য শ্রমিকেরা দায়ী নন। অস্থিরতার ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘটানো হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে একটি চক্র পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চাইছে। ওই চক্র নিরীহ শ্রমিকদের ব্যবহার করছে।

টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কারখানার দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে মুখ্য সচিব আরও বলেন, বর্তমানে দেশে পরিবেশবান্ধব ২২০টি এলইইডি (লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন) সনদযুক্ত তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে, যা বিশ্বের কোনো দেশে সর্বোচ্চ। বাণিজ্যিক সুবিধা জিএসপি প্লাস পাওয়ার ক্ষেত্রে ইইউ বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে বলে নিশ্চয়তা দিয়েছে প্রতিনিধিদল।

এর আগে দুপুরে গুলশানে ইইউর দূতাবাসে ইইউ প্রতিনিধিদল নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (এনএপি) বাস্তবায়নের অগ্রগতিসহ শ্রম খাতের সার্বিক বিষয় জানতে চেয়েছেন ইইউ প্রতিনিধিরা।

বৈঠক শেষে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সাংবাদিকদের বলেন, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শ্রমিকদের মজুরি আরও বাড়ানো দরকার। বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে যে মজুরি ধরা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। শ্রমিক–অস্থিরতার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহার সব সময়ে যৌক্তিক থাকে না।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় যে আলোচনাগুলো হয়, সেগুলোর ফলাফলও সব সময় সঠিকভাবে পাওয়া যায় না—এমন দুর্বলতার বিষয়গুলো বুঝতে চেয়েছে প্রতিনিধিদল। এখানে বলা হয়েছে, আলোচনাগুলোতে মালিকপক্ষের একধরনের প্রভাব থাকে। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যে কমিটিগুলো রয়েছে, সেগুলো কার্যকর নয়, এগুলো আরও কার্যকর করা দরকার বলে আলোচনায় উঠে এসেছে।

সংসদে শ্রম আইনের যে খসড়া এসেছে, সেখানে যে সংস্কারগুলো প্রত্যাশিত ছিল, সেগুলোর মধ্যে একটি বা দুটি বিষয় ছাড়া বাকিগুলো প্রতিফলিত হয়নি বলে জানান গোলাম মোয়াজ্জেম। বলেন, শ্রম আদালত কীভাবে আরও কার্যকর করা যায়, তা ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে নাগরিক সমাজের আলোচনায় এসেছে। সার্বিকভাবে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে আরও সক্রিয় হওয়া দরকার। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো আরও জোরদার হওয়া দরকার। যাতে শ্রমিকদের সমস্যা ও চাহিদাগুলো আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়। এ ছাড়া যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার একটি মধ্যবর্তী মূল্যায়ন হওয়া দরকার। সরকারের সঙ্গে মিলে ইইউ যাতে এটি মূল্যায়ন করে, সে প্রস্তাব নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।

বৈঠকে ইইউর পক্ষ থেকে কোনো উদ্বেগ জানানো হয়েছে কি না, জানতে চাইলে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, তাঁরা সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন। তাঁরা তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করছেন।

এর আগে সকালে ইইউ প্রতিনিধিদল ঢাকায় ইইউ দূতাবাসে শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে। আলোচনা শেষে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সার্বিক শ্রম পরিস্থিতি, শ্রম আইন ও বেতন–ভাতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। শ্রমিকনেতা, সংগঠক ও সাধারণ কর্মী যাঁরা আটক রয়েছেন, তাঁদের মুক্তির প্রসঙ্গও আলোচনায় এসেছে। তিনি বলেন, ‘যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যে শ্রম আইন করা হয়নি, এটি স্পষ্ট করেই আমরা আলোচনায় বলেছি।’

বাংলাদেশের শ্রম অধিকার সুরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কারের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে শ্রম খাতের উন্নয়নে এনএপি গৃহীত হয়। ২০২৬ সালের মধ্যে এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারের সহযোগিতা করছে। বাংলাদেশের এনএপি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে ২০২১ সালে। এখন শ্রম খাতের এনএপি বাস্তবায়নে কতটা অগ্রগতি হলো, তা নিয়ে আলোচনা করতেই এসেছে ইইউ প্রতিনিধিদলটি।