ডেঙ্গু পরিস্থিতি
বাড়ছে আক্রান্ত শিশু
সুস্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার চেয়ে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে বেশি। ফলে বাড়ছে মেঝেতে শয্যার সংখ্যা।
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অধিকাংশ রোগী ও তাঁদের স্বজনদের চোখে এখন ভয়। অসহায় মানুষেরা কেউ বিশেষ কথা বলতে চান না। এই নিরুপায় পরিস্থিতির মধ্যেও গতকাল শুক্রবার দুপুরে একটা সামান্য দৃশ্য অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। সাড়ে তিন বছরের এক শিশু ক্যানুলা লাগানো হাতে ধরে ছিল এক গোছা সাদা টগর ফুল। হাসপাতালের নিচতলার গাছ থেকে আনা ফুল সে মায়ের হাতে বারবার তুলে দিয়ে বলছে, ‘ফুল নাও মা।’
শাহজাহানপুর থেকে আসা মা শাকিলা আক্তার উদ্বেগ চেপেও সন্তানের দিকে হাসিমুখে তাকাতে চেষ্টা করছেন। প্রথম আলোকে বললেন, ‘মেয়ের জ্বর হওয়ার পরপরই চিকিৎসক দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ৯ জুলাই। কিন্তু এক সপ্তাহ পরও বাচ্চার প্লাটিলেট কমছে, এখন আমার ভয় বাড়ছে।’ সাড়ে তিন বছরের মাসুমার রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) বুধবার ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার। গতকাল সকালে তা এক লাখে নেমেছে।
হাসপাতালের সপ্তম তলায় শিশুদের জন্য নির্ধারিত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে গতকাল চিকিৎসা চলছিল ১১২ শিশুর। এক সপ্তাহ আগে ৭ জুলাই এ সংখ্যা ছিল ৮১। সুস্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার চেয়ে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে বেশি। ফলে বাড়ছে মেঝেতে শয্যার সংখ্যা। মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন ‘শিশু ওয়ার্ডের জন্য নির্ধারিত শয্যা ১৪০। ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। জরুরি অবস্থায় প্রয়োজনে পুরো মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। এই ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ২০০ রোগীকে এভাবে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। আরও কিছু শিশুকে আমরা সেবা দিতে পারব।’
এই ওয়ার্ডে একসঙ্গে দুই সন্তানকে নিয়ে ভর্তি হওয়া পরিবারও আছে। ৩ বছরের মেয়ের ডেঙ্গু আর ৯ মাসের মেয়ের টাইফয়েড ধরা পড়েছে। মা একা সামলাচ্ছেন দুই সন্তানকে, এমন দৃশ্য দেখা যায় শুক্রবার দুপুরে। রাজধানীর শাহজাহানপুর থেকে আসা সাত বছরের সামিনা নামের এক শিশুকে পাওয়া গেল, যার প্লাটিলেট ৪০ হাজারের কম। সন্তানকে জড়িয়ে ধরে আতঙ্কে বসে ছিল তার মা ফরিদা পারভিন।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে মুগদা হাসপাতালে। গতকাল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর সংখ্যা এখানে ছিল ৫০২। এ সংখ্যা আগের দিন (বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত) ছিল ৪৮১। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত এখানে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন মোট ১৬৬ জন। মোট চারটি তলার একটিতে শিশু, একটিতে নারী ও দুটিতে পুরুষ রোগীদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় তলায় নারীদের ওয়ার্ডে দেখা গেছে, একই রকম ঠাঁই নেই পরিস্থিতি। মেঝেতে শুয়ে থাকা এক নারী রোগী অভিযোগ করলেন হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে।
রোগীদের যত অভিযোগ
বাসাবো থেকে আসা রোগী আর তাঁর ছোট ভাই বললেন, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য হাসপাতালের শৌচাগার যদি মশা উৎপাদনের কারখানা হয়, কেমন করে হবে? নারী ওয়ার্ডের শৌচাগারের মেঝে পানিতে সয়লাব, বেসিন উপচে পড়েছে ময়লা পানি। নার্সের সংখ্যা খুবই কম। কোনো কোনো রোগীর স্যালাইন শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরও নতুন স্যালাইন দেওয়ার জন্য নার্সদের খুঁজে পাওয়া যায় না। শুক্রবার হাসপাতালের রক্ত পরীক্ষাকেন্দ্র বন্ধ থাকায় অনেক রোগীর পরীক্ষা করতে হয়েছে বাইরে প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে লোক আনিয়ে বেশি টাকা দিয়ে। হাসপাতালে ১৫০ টাকায় রক্ত পরীক্ষা করা যায়, বাইরে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দিতে হয়। রোগীদের অভিযোগ, জরুরি সময়ে শুক্রবার বলে পরীক্ষাকেন্দ্র কেন বন্ধ থাকবে?
নারী ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিন পালায় তাঁরা গড়ে চারজন দায়িত্বে থাকেন। প্রায় দেড় শ রোগীর প্রতিমুহূর্তেই কিছু না কিছু প্রয়োজন হচ্ছে। সুস্থ হয়ে যাঁরা হাসপাতাল ছাড়ছেন, তাঁদের কাগজপত্রও তৈরি করতে হচ্ছে। ফলে হিমশিম খেতে হয়।
এ ব্যাপারে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার দেশের সব সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা বন্ধ থাকে। রোগীর তেমন জটিল অবস্থা হলে নিশ্চয়ই দায়িত্বরত চিকিৎসক জানাবেন এবং ব্যবস্থা হবে। হাসপাতাল থেকে তিনবেলা শৌচাগার, মেঝে পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু রোগীর সঙ্গে থাকা আত্মীয়স্বজন ময়লা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলেন না। পানি দিয়ে শৌচাগার পরিষ্কার করেন না। পরিষ্কারের পরই আবার ময়লা হচ্ছে।
২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত) সারা দেশে নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৪৪৯ জন। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন মোট ২৯৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় কোনো মৃত্যু নেই। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৩ জন। আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১৭ হাজার ৮৩১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় দেশের বেশির ভাগ হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। শনিবারের প্রতিবেদনের সঙ্গে তা সমন্বয় করা হবে।