খেতে না চাওয়া টমি, উকুনে বিল্লুর চিকিৎসা হয় যে হাসপাতালে

চট্টগ্রামের এস এ কাদেরী টিচিং ভেটেরিনারি হাসপাতাল চিকিৎসকেরা যত্ন নিয়েই প্রাণী ও পাখির চিকিৎসা দিয়ে আসছেন
ছবি জুয়েল শীল

টমির বয়স দেড় বছর। লালচে গায়ের রং। চার মাস ধরে খাবার মুখে তুলতে চাইছে না। খাবার মুখে দিলেই বেশির ভাগ সময় বমি করে উগরে দিচ্ছে। চেহারাটাও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এ কারণে টমিকে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএ কাদেরী টিচিং ভেটেরিনারি হাসপাতালে।

গত বুধবার দেশীয় জাতের কুকুর টমিকে ওই হাসপাতালে নিয়ে আসেন সজল বড়ুয়া। দেড় বছর ধরে টমিকে লালনপালন করছেন তিনি। সজল বললেন, আগে কখনো এমনটা হয়নি। টমিকে নানা ধরনের খাবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুই খেতে চাচ্ছে না। আগের চেয়ে রোগা হয়ে গেছে। পরে চিকিৎসকেরা কিছু ওষুধ দিয়েছেন।

শুধু সজল নন, নানা রোগে আক্রান্ত পশুপাখি নিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১০০  ব্যক্তি ভিড় করেন এই হাসপাতালে। সকাল ৯টা থেকেই শুরু হয় হাসপাতালের কার্যক্রম। রোগীর তালিকায় দেশি-বিদেশি কুকুর ও বিড়ালের পাশাপাশি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিও থাকে। মানুষের মতো নানা রোগ নিয়ে আসে এসব প্রাণী। পরে চিকিৎসকেরা সেগুলোর প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন

চিকিৎসকেরা বলছেন, মানুষের মতোই এই হাসপাতালে চিকিৎসা চলে প্রাণীদের। মৌসুমভেদে নানা রোগ নিয়ে প্রাণীদের আনা হয়। এখন শীত মৌসুমে ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে বেশি আসছে প্রাণী-পাখি আনছেন লোকজন।

হাসপাতালের শুরুটা যেভাবে

১৯৯৫-৯৬ সালে ৫০ শিক্ষার্থী নিয়ে নগরের পাহাড়তলী এলাকায় যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ। ছোট পরিসরে হাসপাতালটিও চালু হয়েছিল সে সময়। টিনশেডের কয়েকটি কামরায় চলত চিকিৎসা কার্যক্রম। এরপর কয়েক বছরের মাথায় হাসপাতালটি নতুন রূপে যাত্রা শুরু করে। পাঁচতলা ভবনও পেয়ে যায়।

চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজই ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এটি দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি জনবল নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি সংযোজনে সমৃদ্ধ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি হাসপাতালটিও।

হাসপাতালের পরিচালক মো. রায়হান ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, এখানকার চিকিৎসকেরা যত্ন নিয়েই প্রাণী ও পাখির চিকিৎসা করেন। জটিল অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে জ্বর-কাশি সব চিকিৎসাই দেওয়া হয়। প্রয়োজনে মেডিকেল বোর্ডও গঠন করা হয়। প্রাণীভেদে ২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ফি নেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ভেটেরিনারি হাসপাতালে আনা একটি পোষ্য বিড়াল
ছবি: জুয়েল শীল
আরও পড়ুন

আধুনিক যন্ত্রপাতি, বহুমুখী চিকিৎসা

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে শখের প্রাণীদের নিয়ে ছুটে আসেন মানুষেরা। এ হাসপাতালে প্রাণী ও পাখির সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।

মোট ৯ ভাগে এই সেবাকে ভাগ করা হয়েছে। রোগনির্ণয় থেকে শুরু করে প্রসবজনিত সমস্যা, কৃত্রিম প্রজনন, দাঁতের চিকিৎসা, চামড়ার সমস্যা কিংবা জটিল রোগের অস্ত্রোপচার—সবকিছুর চিকিৎসা পাওয়া যায় এখানে।

সমস্যা সমাধানে রয়েছে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। এক্স-রে, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাফি, সিএস টেস্ট, অ্যান্টিবডি-টাইটার টেস্টসহ সব রকমের পরীক্ষাও হয় এ হাসপাতালে। ছুটির দিন ছাড়া এখানে সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। কাল শনিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ হাসপাতাল।

পা ভেঙে যাওয়া কুকুরকে সারিয়ে তোলার চেষ্টায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা
ছবি: জুয়েল শীল

বুধবার এই হাসপাতালে শখের বিল্লুকে নিয়ে এসেছিলেন চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের বাসিন্দা মো. বাসিত। তিনি জানালেন, বিল্লুর বয়স দেড় বছর। শরীরে প্রচুর উকুন। এ কারণে রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয় বিড়ালটির। পরে চিকিৎসকেরা ওষুধ দিয়েছেন।

প্রিয় পোষ্য বিড়াল জুলিয়াকে নিয়ে বেশ চিন্তিত দেখা গেল সাইমা সুলতানাকে। বেশ কয়েক দিন ধরে জুলিয়ার জ্বর, কাশি। নাক দিয়েও ঝরছে পানি। বুধবার দুপুরে বিড়ালকে চিকিৎসা দিতে নগরের আন্দরকিল্লা থেকে আসেন তিনি।

মানুষের পাশাপাশি তীব্র শীতে ঠান্ডাজনিত জটিলতায় ভুগছে প্রাণীরাও
ছবি: জুয়েল শীল

গ্রাম থেকে শহরে

গৃহপালিত গরু, ছাগল, মহিষ নিয়ে বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম থেকেও এই হাসপাতালে ছুটে আসে মানুষ। বুধবার বেলা তখন ১১টা। ছোট ট্রাকে করে একটা গরু নিয়ে আসেন কৃষক সুনীল নাথ। তিনি আসেন আনোয়ারা উপজেলার সার কারখানা এলাকা থেকে। সুনীল জানালেন, গরুটির বয়স ছয় মাস। দুই দিন আগে হঠাৎ পা ভেঙে যায়। এরপর আর হাঁটতে পারছিল না। পরে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

হাটহাজারীর ফতেপুর গ্রাম থেকে আসেন কৃষক সোবহান মিয়া। তিনি একটি ছাগল নিয়ে আসেন। সোবহান মিয়া বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরে ছাগলটির জ্বর। খাওয়াদাওয়া করছে না। এ কারণে প্রতিবেশীর পরামর্শে তিনি শহরের এই হাসপাতালে আসেন। চিকিৎসা আর গাড়িভাড়া বাবদ তাঁর খরচ হয়েছে এক হাজার টাকা।

সুনীল এবং সোবহানের মতো প্রতিদিন এমন অনেক মানুষ প্রিয় প্রাণীকে নিয়ে গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম নগরের এই হাসপাতালে আসেন। শুরুতে কম এলেও ধাপে ধাপে প্রাণী-পাখি আসার সংখ্যা বেড়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে, ২০১৫ সালে এ হাসপাতালে ৪ হাজার ৮০৬টি প্রাণী ও পাখিকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে প্রায় ৭ হাজার প্রাণী-পাখিকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও পরের বছর করোনার থাবায় সংখ্যাটা কিছুটা কমে।

গবাদিপশু চিকিৎসায় মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে ভেটেরিনারি হাসপাতাল
ছবি: জুয়েল শীল

এরপর ২০২১ সালে প্রায় ৯ হাজার প্রাণী-পাখি সেবা পেয়েছে এই হাসপাতালে। গত বছর এ সংখ্যা পৌঁছে যায় ১৪ হাজারে। এ ছাড়া হাসপাতালে প্রতিবছর গড়ে সাত থেকে আট লাখ টাকা আয় হয় বলেও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম লুৎফুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে আনা প্রাণী ও পাখিগুলোকে আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীরা এখানে হাতে-কলমে চিকিৎসার নানা দিক শিখছেন।