‘অতর্কিতেই আকাশ হানল
বিদ্যুৎময় আলোকচিত্র
নতুন একটা কবিতা পড়তে
উঠে দাঁড়ালেন অরুণ মিত্র।’—কবির সুমন
যখন মোবাইল ফোনের চার্জ কমে আসে, আপনি কী করেন? চার্জ দেন। যখন আপনার মনের চার্জ কমে আসে, আপনি কী করেন? আমি কী করি, আপনাকে বলি। আমি সাইফুল সামিনকে দেখি। আমাদের সহকর্মী, বন্ধু, তরুণতর সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুল সামিন। এখন সামিনের বয়স ৪০ ছুঁয়েছে। সাইফুল সামিন প্রথম আলোয় এবার অন্যতম সেরা কর্মীর পুরস্কার পেয়েছেন। সাইফুল সামিন আজ থেকে ১৭ বছর আগে ছিলেন একজন তরুণ শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র। প্রথম আলোর ঢাকায় থাকি পাতায় প্রদায়ক হিসেবে লিখতেন। খবর সংগ্রহ করতেই গিয়েছিলেন তেজগাঁও রেলস্টেশনে। দুর্ভাগ্যক্রমে ট্রেনের নিচে তাঁর দুই পা চলে যায়, প্রায় কোমরের কাছাকাছি জায়গা থেকে তাঁর দুটো পা কাটা পড়ে। সেই সাইফুল সামিন বেঁচে যান। প্রথম আলো তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর দুটো কৃত্রিম পায়ের তহবিল জোগাড়ের জন্য ক্যাম্পেইন শুরু করে। প্রথম আলো তাতে হাত মেলায়। অনেকের সহযোগিতায় কৃত্রিম পা নিয়ে উঠে দাঁড়ান সাইফুল সামিন।
সাইফুল অন্য যেকোনো সাংবাদিকের মতো নিয়মিত আসেন প্রথম আলোয়। একজন সহকারী নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন তিনি, তাঁকে চলাচলে সাহায্য করার জন্য। তিনি ৫ মিনিট দেরিও করতে চান না। কারও চেয়ে কম কাজও করেন না। তিনি যে আমাদের সেরা কর্মীর পুরস্কার পাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!
৪ নভেম্বর ২০২৫ প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মী সম্মেলনে সেই পুরস্কার নিতে ক্রাচ বগলে কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে মঞ্চে ওঠেন সাইফুল সামিন। কিন্তু তাঁকে এবার অনুষ্ঠানে পুরস্কার নিতে দাঁড়াতে হয় দুবার। আরও একটি পুরস্কার জিতেছেন সাইফুল সামিন। তা হলো কর্মীর লেখা। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাংবাদিক আর সাংবাদিক নন, এমন দুই ভাগে লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে মানবসম্পদ বিভাগ। সাংবাদিক বিভাগে সেরা হয়েছে সাইফুল সামিনের লেখা। তাঁর এই লেখার শিরোনাম ‘মনের অ্যালার্ম’। লেখাটি পড়তে পারেন মনের অ্যালার্ম
সাইফুল সামিন লিখেছেন, অফিসে যাত্রার সময় আসার আগে তাঁর মনে অ্যালার্ম বাজতে থাকে। ওঠো, দাঁড়াও, চলো। অফিসে যেতে হবে। মানুষের কাছে খবর পৌঁছাতে হবে। তাঁর ভাষায়: ‘জামাকাপড় পরে কৃত্রিম পা বেঁধে নিই। ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। ঠক…ঠক…ঠক…শব্দে ভরে ওঠে ঘর। এই শব্দও একধরনের অ্যালার্ম। মনের মধ্যে এমন অ্যালার্ম সারাক্ষণ বাজে। পাঠককে খবর জানানোর তাড়না হয়ে।’
মাঝেমধ্যে মনে হয়, ৬০ বছর পার করলাম, কিছুই তো করলাম না। কিছুই তো হলো না। কিছুই তো হলো না।
সেই সব-সেই সব-সেই হাহাকাররব,
সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা ।।
কিছুতে মনের মাঝে শান্তি নাহি পাই,
কিছুই না পাইলাম যাহা কিছু চাই।
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একটা গাছ লাগাইনি, একটা মুঠো ধান উৎপাদন করিনি, একটা ফুলও ফোটাইনি। জীবন ফুরায়ে আসে...ঠিক এই রকম সময়ে আমি তাকাই সাইফুল সামিনের দিকে। জাগো, ওঠো, দাঁড়াও, চলো। চরৈবেতি। চলো। এগিয়ে চলো। থেমো না। আইনস্টাইনের ভাষায়, জীবন হলো বাইসাইকেলের মতো, সব সময় চালাতে হয়, তা না হলে পড়ে যেতে হয়।
একটা দিন আমাদের নিজেদের
হেমন্তকাল এলে কিন্তু বাংলাদেশ সুন্দর হয়ে উঠতে থাকে। বিকেলে রোদের রং হলুদ হয়ে পড়ে। আকাশে ঝকঝক করে, মাজা কাঁসার বাসনের মতো রোদ, আর ঘন নীল পটে সাদা মেঘ। শীতের আমেজ। বাতাসে গন্ধ, শীত আসছে। তখনই প্রথম আলোর হাজার কর্মীর প্রত্যেকের মনে উৎসবের আনন্দ। ৪ নভেম্বর আসছে। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সবাই নতুন উদ্যমে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেমন ছোটবেলায় ঈদের বেশ কদিন আগে থেকেই সেমাই মেশিন ঘোরানো, জুতায় রং করা, পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম আর মনের মধ্য ফুর্তির হিল্লোল জাগত, ঈদ আসছে। আমরা, প্রথম আলোর প্রত্যেক কর্মী ৪ নভেম্বরের আগে থেকেই সাজ সাজ রবে মেতে উঠি। নতুন একটা টি–শার্ট পরে যেতে হবে সম্মিলনীতে, প্রশাসন বিভাগ ব্যস্ত টি–শার্ট সাইজমাফিক বিতরণে। নারী সহকর্মীরা পাবেন শাড়ি। ব্লাউজ তো ম্যাচ করতে হবে। দুপুরে কাচ্চি বিরিয়ানি। ইকবাল ক্যাটারিং। আমার জন্য এর চেয়ে বড় মোটিভেশন আর কী হতে, যার মধ্যপ্রদেশ ভীষণ রকম স্ফীত! সকালে নাশতা কী হবে? আচ্ছা, এবারের স্লোগান কী! বিজ্ঞাপনের ডিজাইন কারা করছেন।
দিল্লি থেকে আসছেন সুদর্শন সুহাস সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, মুম্বাই থেকে দেবারতিদি, কলকাতা থেকে অমরদা, সিডনি থেকে কাওসার, লন্ডন থেকে সাইদুল ইসলাম, জার্মান প্রতিনিধি শরাফ আহমেদ...দেখা হবে, মোলাকাত হবে। রংপুর থেকে আসছেন আরিফুল হক রুজু ভাই, রাজশাহী থেকে আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, সারা দেশ থেকে শতজন। সবার এক টি–শার্ট, সবার মুখে হাসি, কারণ আমরা এক টিম। আমরা জানি আমরা চ্যাম্পিয়ন। বাংলাদেশের ৫৭ ভাগ পাঠক পড়েন প্রথম আলো। প্রথম আলো বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক। প্রথম আলো ডটকম বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট। প্রথম আলো ফেসবুকে দুই কোটির বেশি অনুসারী।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার একটা ফর্মুলা আছে। কঠোর পরিশ্রম, সাধনা, কোনো শর্টকাট নেই। লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য পরিষ্কার থাকতে হবে। জিততে চাইতে হবে, শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য, মানুষের জন্য। আর? একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে চলতে হবে। শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, ১০০টি ম্যাচ একটা টিম একসঙ্গে থেকেছিল, অনুশীলন করেছিল। জার্মানি যেবার ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারায় এবং চ্যাম্পিয়ন হয়, তারা ব্রাজিলে দ্বীপ ভাড়া করে একসঙ্গে অনুশীলন করেছিল দীর্ঘদিন। আমরাও, প্রথম আলোর প্রায় হাজার কর্মী, এক লক্ষ্যে একসঙ্গে আছি, ৪ নভেম্বর কেআইবি মিলনায়তনে সেই আশ্বাসটা পাওয়া যায়। সুমনা শারমীন উপস্থাপনা করেন। আমরা খিলখিল করে হাসি, সবাই মিলে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাই, আফজাল হোসেন, মানজুর আল মতিন, মেরিনা তাবাশ্যুম, ক্রাউন সিমেন্টের আলমগীর ভাইয়ের কথায় প্রেরণা পাই, মাহ্ফুজ আনাম চ্যালেঞ্জের কথা বলে আমাদের উদ্দীপিত করেন, নন্দিতা আর শুভেন্দুর কণ্ঠে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ থেকে ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ শুনে প্রাণিত বোধ করি। সাজ্জাদ শরিফ স্বাগত জানান আর প্রথম আলোর আন্তর্জাতিক পুরস্কারের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
শেষে আসেন মতি ভাই। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তাঁকে একজন প্রশ্ন করেন, আপনার নাকি অনেক ক্ষমতা। এটা পাবলিক পারসেপশন? কেন বলে?
মতি ভাই হাসেন। বলেন, আমার ক্ষমতা থাকলে তো আমিই ক্ষমতা নিতাম। নিই না কেন? আমি সাংবাদিক। আমার কাজ জানা। ইনফরমড থাকা। আমি তাই যোগাযোগ রাখি। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। অধ্যাপক ইউনূসের সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি। সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি। অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা করি, যোগাযোগ রাখি। আর প্রথম আলোয় যাঁরা লেখেন, তাঁরা পরিচিতি পান। জনপ্রিয়তা পান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বে তাঁরা এগিয়ে আসেন। এই তো...
আরেকজন প্রশ্ন করেন, আপনার তারুণ্যের রহস্য কী? মতি ভাই বলেন, আমার বয়স ৮০ হলো। নানা ধরনের অসুখ। চারটা–পাঁচটা সিরিয়াস রোগ নিয়ে আছি। রোজ সকাল সাড়ে ৫টায় উঠি। রোজ এক ঘণ্টা হাঁটি। হিসাব করে খাই। বিকেলে আধা ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করি। রাত ১২টায় ঘুমাতে যাই। আর চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলি। এই তো!
প্রথম আলো আর দেশ নিয়ে মতি ভাই তাঁর ভাবনা আমাদের জানান। দেশে বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমরা এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই। এই পরিবর্তন অনিবার্য ছিল। কারণ, এই রকম একটা শ্বাসরোধী গণতন্ত্রহীন মানবাধিকারহীন গুম–খুন–লুণ্ঠনময় শাসন চলতে পারে না। অনেক আশা ছিল মানুষের। সব আশা পূরণ হয়নি। একবারে হবে না। সামনে নির্বাচন হবে। হতেই হবে। ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে। এসবই বাস্তবতা। আমাদের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে হবে। নতুন যুগের নতুন প্রজন্মের চাহিদা নতুন। মনের আকার নতুন। আবার টেকনোলজির পরিবর্তন বাস্তবতা বদলে দিচ্ছে প্রতি মূহূর্তে। আমরা এই চ্যালেঞ্জে নতুন করে জাগব। এখনই সত্য প্রকাশের সময়। এখনই সুসাংবাদিকতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
আর আমরা কি হাল ছেড়ে দেব? আমরা গণতন্ত্র চাই, আমরা মানবাধিকার চাই, আমরা ঐক্য চাই, সমঝোতা চাই। আমরা অসাম্প্রদায়িকতা চাই। মুক্তিযুদ্ধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখতে চাই। আমরা বৈষম্যের অবসান চাই। আমরা আমাদের এই লক্ষ্য থেকে সরে আসব না। আমরা থেমে যাব না। আমরা হাল ছেড়ে দেব না।
যে বক্তৃতা আমার দেওয়ার কথা ছিল
সুমনা শারমীন বলে রেখেছেন, কেআইবির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মী সম্মেলনে আপনার কাজ হলো, মোটিভেশনাল স্পিচ দেওয়া। কর্মীদের উৎসাহ দেবেন। আমি ব্যাপক পড়াশোনা করে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। এবারের স্লোগান: ‘সত্যই সাহস’। আমরা সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত নই। এই সত্যই আমাদের সাহসের উৎস। এ বিষয়ে কী কী বলা যেতে পারে।
কিন্তু সব গান-পুরস্কার-বক্তৃতার পর দুটো বেজে যাচ্ছে। কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কর্মীদের মন উচাটন, পেটে অ্যাসিডিটির ঝলকানি, জিবে জল।
আমার বক্তৃতা কেউই শুনবে না। কাজেই বললাম, আমি সবচেয়ে জরুরি ঘোষণা দিচ্ছি। কাচ্চির আলু গরম আছে, কেবল চুলা থেকে নামল, চলুন, আগে অতিথিদের খেতে দিই, তারপর নিজেরা খাই। মনে মনে আওড়ানো বক্তৃতা গিলে খেতে হলো।
সেই ভাষণটা এখন আমি দেব।
আমি প্রথম আলোর ম্যানেজিং এডিটর। টাইম ম্যাগাজিনের ম্যানেজিং এডিটর ছিলেন রিচার্ড স্টেংগেল। নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনী লেখার জন্য তাঁর সঙ্গে বহু বছর কাটিয়েছেন। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার একটা গল্প বলে থাকেন।
একবার নেলসন ম্যান্ডেলা প্লেনে চড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন। সঙ্গে আছেন দেহরক্ষী মাইক। আকাশে প্লেন ওড়ার পর প্রপেলারে সমস্যা ধরা পড়ল। নেলসন ম্যান্ডেলা বললেন, মাইক, দেখো তো। খোঁজ নাও। প্রপেলার কি ঠিকমতো কাজ করছে না? প্লেন এই রকম কাঁপাকাঁপি করছে কেন?
মাইক ককপিটে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানাল, হ্যাঁ। প্রপেলার ঠিকমতো কাজ করছে না।
ম্যান্ডেলা তখন পত্রিকা বের করে মন দিয়ে পড়তে লাগলেন। প্লেন এয়ারপোর্টে নামল। সেখানে ব্যাপক প্রস্তুতি। দমকলকর্মী, উদ্ধারকারী কর্মী। অ্যাম্বুলেন্স। (শেষকৃত্যের লোকেরা এসেছে কি না, জানা যায়নি)।
নির্বিকার ম্যান্ডেলা প্লেন থেকে নামলেন। সেখানে রিচার্ড স্টেংগেল ছিলেন। সব শুনে তিনি বললেন, ম্যান্ডেলা, আপনি কি ভয় পাননি?
ম্যান্ডেলা বললেন, কী বলো, আমি তো ভয়ে মারা যাচ্ছিলাম।
এইবার এল সেই প্রসঙ্গ, ম্যান্ডেলার অমর উক্তি, ‘সাহস মানে ভয়হীনতা নয়। সাহস হলো ভয়কে জয় করার চেষ্টা।’
আমি মতি ভাইকে একাধিকবার বিপদের মুখে নির্বিকার থাকতে দেখেছি। একবার রাজশাহীতে তিনি যাচ্ছিলেন প্লেনে। প্লেন তিনবার চেষ্টা করেও নামতে পারেনি। আর ভয়াবহ ঝাঁকুনি খাচ্ছিল। সেটা খবরের কাগজে খবর হয়ে এল। আমি বললাম, আপনি না এই প্লেনে ছিলেন। তিনি নির্বিকার।
একবার প্রথম আলো থেকে বেরিয়েছেন গাড়িতে। একটা মিছিল বেরিয়েছে। পুলিশ গুলি করল। সেই গুলি এসে লাগল তাঁর গাড়ির কাচে। কাচ ভেঙে তাঁর গায়ে লাগল। রক্ত বেরোতে শুরু হলো। তিনি অফিসে এসে কাউকে কিছু না বলে ডেটল–তুলা দিয়ে রক্ত মুছলেন। কাউকে বললেন না যে তাঁর গাড়িতে গুলি লেগেছিল। আরেকবার কোর্টে হাজিরা দিয়ে আসার সময় তাঁর গাড়ি পড়ল বিক্ষোভকারীদের মিছিলের মধ্যে।উত্তেজিত জনতা নির্বিচার গাড়ি ভাঙচুর করছে। তাঁর গাড়ির কাচ ভেঙে গেল। তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে গাড়ি থেকে নেমে একটা স্কুটারে উঠে অফিসে চলে এলেন।
একবার তাঁর বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছেন। বিকেল হয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তিনি তখন বিজ্ঞাপন বিভাগের সঙ্গে মিটিং করছেন। আমি বলি, মতি ভাই ওঠেন। আপনাকে ধরতে পুলিশ আসবে তো! তিনি উঠলেন না। মিটিং চালিয়েই যেতে লাগলেন।
প্রথম আলো অফিসের সামনে কয়েকজন লোক সাত দিন ধরে মাইক লাগিয়ে বিশৃঙ্খলা করেছে। তিনি রোজ এসেছেন। ওদের সামনে দিয়ে অফিসে ঢুকেছেন। বেরিয়ে গেছেন। বিচলিত হননি।
আমার নিজেরও মাঝেমধ্যে বিপদ কিংবা আপদ আসে। তখন আমি চেষ্টা করি মাথা ঠান্ডা রাখতে। প্রথম যে কাজটা করি, মতি ভাইকে জানাই। তারপর মতি ভাইয়ের সামনে গিয়ে আধা ঘণ্টা বসে থাকি।
ওই আধা ঘণ্টায় আমার দুশ্চিন্তা কেটে যায়। আমি সাহস নিয়ে, অনেক সাহস নিয়ে বের হয়ে আসি। কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
তখনো বুঝেছি, এখনো বুঝি, তাঁর এই সাহসের উৎস সততা। নিষ্ঠা। উদ্দেশ্যের সততা। অনেস্টি অব পারপাস। সত্যই সাহস।
মাকে মনে পড়ে আমার
একদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। ২০ ফেব্রুয়ারি। আমি বইমেলায়। মতি ভাইয়ের ফোন এল। আনিস, কী করো?
বইমেলায় অটোগ্রাফ দিই।
বাসায় যাও। শাওয়ার নাও। এক কাপ কফি খাও। তারপর একটা কবিতা লেখো। কাল একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি একটা কবিতা প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপাব। তুমি লিখে দাও।
আমি বাসায় গেলাম। একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলাম সাড়ে নয়টার মধ্যে। মায়ের আঁচলে লুকোই মুখ। শেষ লাইনগুলো এ রকম:
‘আম্মার আঁচলে মুখ মুছে
আকাশে তাকিয়ে দেখি, সপ্তর্ষিমণ্ডলে আজও প্রশ্নচিহ্ন আঁকা।
শহীদেরা শুধোন সওয়াল, তোমরা কি আমাদের মতো নির্ভয়ে বলো?
শহীদেরা শুধোন সওয়াল, তোমরা কি আমাদের মতো নির্ভয়ে চলো?
আম্মার আঁচলে ফের লুকোতে চাই মুখ।
যদি পাই আজও কিছু রোদ্দুরের ঘ্রাণ।
যদি মোছা যায় কপালের বিন্দু বিন্দু নিরুত্তর ঘাম।’
শহীদেরা যদি প্রশ্ন করেন, আমরা কি কথা বলার সময় নির্ভয়ে কথা বলতে পারি? এর উত্তর তখনো ছিল ‘না’। এখনো বোধ হয় ‘না’। ভয় তো আছেই। কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, সাহস মানে ভয়হীনতা নয়, ভয়কে জয় করার চেষ্টা করা।
মতি ভাই কবিতাটা পড়ে বলেছিলেন, তোমার মায়ের প্রতি একটা বিশেষ ভালোবাসা আছে। নানা লেখায় ওটা প্রকাশিত হয়।
আম্মা মারা গেলেন করোনার আগের বছর। আইসিইউতে ছিলেন। মারা যাবেন, সেটা আগের রাতেই আমরা বুঝে ফেলেছিলাম। পরের দিন আমার একটা লেখা দেওয়ার কথা। একজন তারকার সাক্ষাৎকার। আমি জানি, সকাল হওয়ার আগেই নিষ্ঠুর দুঃসংবাদটা আসবে। কাল আর আমি লিখতে পারব না। আমি রাত সাড়ে ১১টায় ফোনে তারকাকে ধরে ফেললাম। সাক্ষাৎকার নিলাম। রাত দুটোয় লেখাটা পাঠিয়ে শুতে গেলাম। ভোর পাঁচটায় ফোনটা এল। আম্মা আর নাই।
সেই দিনটাও ছিল এমনি এক নভেম্বর। আমরা, সদ্য মা হারানো ভাইবোন, আমাদের পরিবার নিয়ে চললাম রংপুর। রংপুর গোরস্তানে আম্মাকে গোরে শুইয়ে ঢাকা ফিরে এলাম।
দুই দিন পর সোনারগাঁ হোটেলে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এসে হাজির হলাম।
রবীন্দ্রনাথ থেকে সান্ত্বনা নিতে হয়—
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ...
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥’
মতি ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম...
মতি ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি বিপদের মুখে এত শান্ত থাকেন কীভাবে? তিনি বললেন, অভিজ্ঞতা দিয়ে। অশান্ত হলে বিপদ তো কমবে না। শান্ত থাকলে সমস্যার একটা ভালো সমাধান বের করা যাবে। এ কথা বলে তিনি নিজের কাজ শুরু করলেন।
এই তো কয়েক দিন আগের ঘটনা। বড় ভাই বিজ্ঞানী রেজাউর রহমানের শেষ দিনগুলোয় কঠিন চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার—সবকিছু সারলেন। আইসিইউতে ভেন্টিলেটরে বড় ভাই। ডাক্তার বললেন, সব শেষ। তিনি শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হলেন। হসপিটালে গেলাম। এখন ভেন্টিলেটর খুলে নেওয়া হবে। মতি ভাই দুঃখিত। কিন্তু শক্ত। সারা দিনে এইসব কাজ, ব্যস্ততা, দায়িত্ব সেরে বিকেলে গেলেন দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আগে থেকে ঠিক করে রাখা মিটিং সারতে। সন্ধ্যার পরে প্রথম আলোয় এসে হাজির তিনি। পরের দিনের কাগজ কী হবে, বসে বসে লেখা পড়ছেন। নির্দেশনা দিচ্ছেন। আবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কাজের অগ্রগতির খোঁজ নিচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে তাঁকে দেখছি...
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥