চলন্ত বাসে তরুণীকে ধর্ষণ-হত্যা মামলায় সাজা কমল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির
সাত বছর আগে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামির মধ্যে তিন আসামির সাজা কমিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তাঁদের মধ্যে দুজনের যাবজ্জীবন ও একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি আকরাম মারা গেছেন। তাঁর আপিলের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. তৌফিক ইনামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার এ রায় দেন। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) এবং জেল আপিল ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে এ রায় দেওয়া হয়।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন বাসচালকের সহকারী শামীম ও জাহাঙ্গীর। আর বাসচালক হাবিব মিয়াকে সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে যাচ্ছিলেন ওই তরুণী। যাওয়ার পথে তাঁকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়।
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে যাচ্ছিলেন ওই তরুণী। পথে তাঁকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। তিনি একটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামে। তাঁর কর্মস্থল ছিল শেরপুর জেলায়। এ ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
আলোচিত এই ধর্ষণ-হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রায় দেন। রায়ে ছোঁয়া পরিবহন বাসটির চালক হাবিবুর, চালকের সহকারী শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর বাসের সুপারভাইজার সফর আলীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়সহ ওই মামলার যাবতীয় নথিপত্র ২০১৮ সালে হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছায়, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। ফৌজদারি কোনো মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কারও মৃত্যুদণ্ড হলে, তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যেটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। এদিকে বিচারিক আদালতের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা জেল আপিল, নিয়মিত আপিল করতে পারেন হাইকোর্টে। সাধারণত ডেথ রেফারেন্স ও এসব আপিলের ওপর একসঙ্গে হাইকোর্টে শুনানি হয়ে থাকে। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বাসচালক, সুপার ভাইজার, হেলপারসহ দণ্ডিত পাঁচ আসামি জেল আপিল ও আপিল করেন। ডেথ রেফারেন্স ও এসব আপিলের ওপর শুনানি শেষে রায় দেন আদালত।
আদালতে আসামিপক্ষে আইনজীবী মো. আহসান উল্লাহ, দেলোয়ার হোসেন, বুলবুল রাবেয়া বানু ও সেলিনা ইয়াসমিন শুনানিতে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মাসুদ রানা, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মীর মনিরুজ্জামান, আয়শা আক্তার ও তারেক রহমান।
হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রায় শুরু করেন আদালত, আজ বেলা তিনটায় রায় ঘোষণা শেষ হয়। বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামির মধ্যে আকরাম মারা গেছেন। তাঁর আপিলের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। অপর তিনজনের মধ্যে হেলপার শামীম ও জাহাঙ্গীরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদণ্ডের সাজা পরিবর্তন বাসচালক হাবিব মিয়াকে ৭ বছর কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিচারিক আদালতের রায়ে বাসের সুপারভাইজার সফর আলীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যা বহাল রয়েছে। তবে সাজা ভোগ করে ইতিমধ্যে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাসুদ রানা বলেন, বিচারিক আদালতের রায়ে ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগী পরিবারের অনুকূলে টাকা দিতে বলা হয়েছিল। এ বিষয়ে বাসমালিকের করা আপিল মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ে বাসটি প্রকৃত মালিককে দিতে বলা হয়েছে। তবে দণ্ডিত দুই আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট। এই অর্থ ভুক্তভোগী পরিবার পাবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুসারে, পুলিশ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতেই ওই তরুণীর লাশ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্ত শেষে পরদিন বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় অরণখোলা পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে মধুপুর থানায় মামলা করেন। তাঁর ভাই ওই বছরের ২৮ আগস্ট মধুপুর থানায় এসে লাশের ছবি দেখে তাঁকে শনাক্ত করেন। পরে পুলিশ ছোঁয়া পরিবহনের চালক হাবিবুর এবং চালকের সহকারী শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা পাঁচজনই আদালতে জবানবন্দি দেন।