শহরে এল আবার তারা
রাজধানী ঢাকায় পাখপাখালির কলকাকলি বিশেষ তেমন কানে আসে না। এখানে পথে নামলে হাজার হাজার যানবাহনের অনেক প্রকার হর্নের উচ্চ শব্দের তাণ্ডবে কানের পর্দার যাই যাই দশা। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ প্রভৃতিতে ঢাকার উত্থান ঘটছে শনৈঃশনৈঃ। দূষিত শহরের বৈশ্বিক তালিকায় অবস্থান এখন শীর্ষ পর্যায়ে। সবুজ সীমিত। ক্রমেই তা আরও সংকুচিত হচ্ছে বহুবিধ প্রয়োজন ও উন্নয়নের সাঁড়াশি আক্রমণে। এমন পরিবেশে গবাদিপশুর হাঁকডাক শুনতে পাওয়ার কথা নয়। তবে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় সেই অভাবিত সাড়াশব্দ কানে আসে। ‘গরুর হাম্বা’, ‘ছাগলের ম্যাঁ’ চলতি পথে কানে আসে বড় বড় বহুতল বাড়ির আশপাশ থেকে। বছর ঘুরে আবার এসেছে সেই সময়টি।
‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে’ এমন দৃশ্য না হলেও গরুর গলার দড়ি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সড়কে। ফ্ল্যাটের গ্যারেজে বেঁধে রাখা ছাগলকে পরম আদরে কাঁঠালপাতা খাওয়াতেও দেখা যাবে কচিকাঁচাদের। অনেক এলাকার সড়কে রীতিমতো সুসজ্জিত তোরণ দেখা যাচ্ছে। ওপরের অংশে হৃষ্টপুষ্ট ষাঁড় আর তাগড়া খাসি-ভেড়ার ছবি। ক্রেতাদের স্বাগত জানানো হয়েছে কোরবানির বিরাট হাটে। সারা জীবন আপন চরণে চলাচল করা চতুস্পদগুলোকে কিছুটা বিহ্বল–উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ট্রাকে পরিভ্রমণ করায়। নগরীর এসব মৌসুমি পশুর হাটে আসছে এমন শত শত ট্রাক। সেখান থেকে সাবধানে নামানো হচ্ছে পশুগুলো। তারপর সেখান থেকে দরদামে বনিবনা হলে ক্রেতারা নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের বাসাবাড়িতে। কোরবানির ঈদ নিয়ে এই চেনা দৃশ্য ফিরে এসেছে রাজধানীতে। সারা দেশের কোরবানির পশুর হাটের দৃশ্যপটও কমবেশি এমনই।
নিজের পালা–পোষা পশু কোরবানি করাই সর্বোত্তম। সে সুযোগ-সামর্থ্য মুষ্টিমেয় কিছু মানুষেরই আছে। বৃহত্তর কোরবানিদাতাদের ভরসা ওই ‘বিরাট গরু-ছাগলের হাট’। এখন রাজধানীর বছিলা, রায়েরবাজার এলাকার বেশ কয়েকটি হাটের তোরণ ও ব্যানারে অবশ্য ‘কোরবানির পশুর বিরাট হাট’ লেখনীও চোখে পড়েছে। হাটে পশুর সঙ্গে তাদের উপাদেয় খাবারের পসরাও আছে। ছাগলের প্রিয় কাঁঠালপাতা। গরু-মহিষের পছন্দ সতেজ ঘাস, পরিষ্কার বিচালি। বিশেষ পানীয় তৈরির জন্য আছে বিভিন্ন শস্যের ভুসি, চিটাগুড়। এখন তো ফাস্ট ফুডের জমানা। গবাদিপশুই-বা বাদ যাবে কেন? অতএব তাদের জন্যও আছে কারখানায় উৎপাদিত উপাদেয় খাবার।
ঈদে সাজসজ্জার একটা ব্যাপার থাকেই। কোরবানির পশুদের জন্যও তা প্রযোজ্য। প্রতিটি হাটেই রয়েছে পশুদের অলংকারের দোকান। সেখানে বিকাচ্ছে রঙিন দড়ি, কাগজের ফুল, কাপড়ের ঝালর, জরির মালা, শিং সাজানোর রাংতা, টিকলির মতো কপালে আটকে রাখার নকশা—এমন আরও কত কী!
কোরবানির পশুর আহারে–আয়েশে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে, সে চেষ্টা আন্তরিকভাবেই করে থাকেন কোরবানিদাতারা। পশুর জন্য খাবার পরিবেশন করার পাশাপাশি গরমের দিনে ফ্যানের ব্যবস্থাও করা হয়। অনেক বাড়িতেই জায়গার টানাটানি। এসব বাড়ির সামনে বা পাশের সড়কের ফুটপাত ঘেঁষে বেশ শক্তপোক্ত ছাউনি করে শামিয়ানা টাঙিয়ে অস্থায়ী পশুনিবাস তৈরি করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাক-ট্রলারযোগে রাজধানীতে আসা ও হাটের ঘিঞ্জি পরিবেশে বিক্রি হওয়ার প্রতীক্ষার প্রহর কাটিয়ে আসা ক্লান্ত পশুগুলোর আশ্রয় হয়েছে সেখানে। এখন জাবর কেটে ক্লেশ–ক্লান্তি নিবারণ করছে তারা। বাড়ির ছোটরা খানিকটা দূর থেকে কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে দেখে তাদের। কেউ কেউ সাহস করে দু-এক পা এগিয়ে গিয়ে খাবারের পাত্র এগিয়ে দেয়। বড়রা পরম মমতা ও ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে দেন সদ্য ক্রয় করা ছাগল বা ষাঁড়ের মাথায়, কাঁধে ও পিঠে। করুণাময় স্রষ্টা তাঁর বান্দার শুধু নিখাদ ভক্তি ও ভালোবাসাই গ্রহণ করেন। উত্তম প্রতিদান দেন। অন্য কিছু নয়।