সুন্দরবন ভালো থাকলেই ভালো থাকবে বাংলাদেশ

যখনই কোনো ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হয় তখনই সুন্দরবন বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায় সামনে। নিজেকে ক্ষতি করে রক্ষা করে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশকে ভালো রাখতে, সুন্দরবনকে ভালো থাকতে বনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পাশে থাকতে হবে। প্রতিবার সুন্দরবন যেন বাংলাদেশের ভূখন্ডের অধিবাসীদের রক্ষায় নিজের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন কেমন আছে সুন্দরবন?

সিডর বা আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোেগর পর সুন্দরবন নিয়ে প্রকাশিত হয় নানা রকম প্রতিবেদন

গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের ওপরে অন্তত ১৬টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে। এর অন্তত অর্ধেক ঝড় সুন্দরবনকে আঘাত করে বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়েছে। ঝোড়ো হাওয়া আর জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতায় সুন্দরবনের গাছ–পালা, প্রাণী আর অবকাঠামো বার বার ক্ষতির মুখে পড়েছে। কিন্তু প্রতিবার সুন্দরবন যেন বাংলাদেশের ভূখন্ডের অধিবাসীদের রক্ষায় নিজের ক্ষতি পুষিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে প্রকৃতির ওই ক্ষত এমনি এমনি সেরে ওঠেনি। এর জন্য সুন্দরবনকে সুযোগ দিতে হয়েছে। যার সূত্রপাত হয়েছিল ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতের পর। ওই ঝড়ের পর সুন্দরবনের কয়েক লাখ গাছ উপড়ে পড়ে।

বনবিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, উপড়ে পড়া সেই সব গাছ কেটে ফেলে নিলামে বিক্রি করা হবে। প্রথম আলো তখন সুন্দরবনে সরেজমিন ঘুরে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন করে। ওই শ্বাসমূলীয় বন ঝড়ের পরে কীভাবে আবারও ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে—তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁদের পরামর্শ নিয়ে ‘বিরক্ত না করলে বাঁচবে সুন্দরবন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন করে। তৎকালীন সরকার ওই প্রতিবেদনে দেওয়া পরামর্শকে আমলে নিয়ে সুন্দরবনের উপড়ে পড়া কোনো গাছ না কাটার সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলাফল ঠিক এক বছরের মাথায় বনবিভাগ পায়। এক বর্ষার বৃষ্টি আর সারা বছরের জোয়ার–ভাটার প্রভাবে সুন্দরবনের গাছপালা আবার সবুজ আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এর পর সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতেও বদল আসে।

সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আদায়ের চিন্তা থেকে সরে এসে এর বিপন্নপ্রায় জীববৈচিত্র ও বণ্যপ্রাণীদের রক্ষার উদ্যোগ বাড়ায়। বেঙ্গল টাইগারসহ অন্য প্রাণীদের সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়।

ওই সিদ্ধান্তের কয়েক বছরের মাথায় উদ্যোগটির সফলতা মুখ দেখে। সুন্দরবনকে বিরক্ত না করায় বনের গাছপালাও বৃদ্ধি পায়। ২০১৫ সালে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা যেখানে পাওয়া গিয়েছিল ১০৫টি, তা ২০১৯ সালে বেড়ে হয় ১১৪টি। বনের অন্য প্রাণীদেরও বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ফলে সুন্দরবন শুধু ঝড়–জলোচ্ছ্বাস থেকেই আমাদের রক্ষা করছে না, এই বন হয়ে উঠেছে বিশ্বের বিপন্ন ৩১ প্রজাতির প্রাণীর আশ্রয়স্থল।   

আরও পড়ুন

বনবিভাগ এখন শুধু বছরে ছয় মাস সুন্দরবন থেকে মাছ ও কাকড়া ধরার সুযোগ দেয়। বন থেকে কাঠ চুরি ঠেকাতে গোলপাতা কাটার সুযোগও সীমিত করা হয়েছে। বনের চারপাশে মাছ, কাকড়া ও গোলপাতার চাষ করার ব্যাপারে স্থানীয়দের উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর বাইরে বছরে তিন–চার মাস মধু ও মোম আহরণ করতে দেওয়া হয়। ফলে এই বনটিকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তবে এরপরও সুন্দরবনে যে বিপদ নেই, তা নয়।

চোরাশিকারীরা বনের মধ্যে এখনো সক্রিয়। বনের ভেতর দিয়ে এখনো জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান চলাচল করছে। এসব শব্দবহুল ও দূষণ সৃষ্টিকারী তৎপরতা বনের বিপদ বাড়িয়ে তুলছে। সুন্দরবন রক্ষায় এসব বিপদ নিয়েও প্রথম আলো বার বার প্রতিবেদন করেছে। বনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল নিয়ে প্রতিবেদন করার পর বিকল্প পথ হিসেবে ঘসিয়াখালী খাল খনন করা হয়েছে। আশা করা যায়, সামনে এমন আরও বিকল্প পথ বের করে সুন্দরবনের বিপদ কমানো সম্ভব হবে। সুন্দরবনকে রক্ষা করে, বাংলাদেশকে ঝড়–জলোচ্ছ্বাসের বিপদ থেকে বাঁচাবে।