মোড়ে বিশৃঙ্খলা, ফাঁকায় গাড়ির বেপরোয়া গতি 

সড়কটিতে এক বছর চার মাসে প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন। ঘটেই চলেছে ছোট–বড় দুর্ঘটনা। 

চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। বুধবার দুপুরেছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের ব্যস্ততম বড় মোড়গুলোর অন্যতম রাউজানের পাহাড়তলী। অফিস, বিপণিবিতান, হাসপাতালের কারণে সব সময় শত শত মানুষের ভিড় থাকে। ব্যস্ত এই মোড়ে যানবাহন চলাচল করে বিশৃঙ্খলভাবে। সড়কের ওপর দাঁড়িয়েই চলে যাত্রীরা ওঠানামা। হুটহাট বাস-ট্রাকের সামনে এসে পড়ে তিন চাকার যান।

শুধু পাহাড়তলী নয়, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের ১১টি মোড়ে নিয়মশৃঙ্খলার ছিটেফোঁটাও নেই। সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। পার্কিংও চলে সড়কের ওপর। এ ছাড়া সড়কের ওপরই বসে বাজার। আবার মোড় পেরোলেই যানবাহনগুলো বেপরোয়া গতির ‘প্রতিযোগিতায়’ নামে। ফলে ছোট–বড় দুর্ঘটনা লেগেই আছে। এক বছর চার মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন। 

সর্বশেষ গত সোমবার রাঙ্গুনিয়ার জিয়ানগর এলাকায় ঘুরতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থী। এরপর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে টানা চার দিন আন্দোলনে করেন। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কটি চার লেনে প্রশস্ত করার দাবি জানান তাঁরা। 

সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরের কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত সড়কটির দূরত্ব প্রায় ৪৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার। ১৯৬২ সালের দিকে সড়কটি নির্মাণ হয়। দুই লেনের সড়কের গড় প্রশস্ততা ৬ দশমিক ২ মিটার। প্রতিদিন যাতায়াত করেন পাঁচ উপজেলা-হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, কাপ্তাই ও বিলাইছড়ির কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ। এ সড়কে দূরপাল্লার বাস, ট্রাক, মিনি ট্রাক, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত কার ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল করে। তবে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দাপট সবচেয়ে বেশি। চালকদের হিসাবে, অন্তত ১০ হাজার অটোরিকশা চলাচল করে এই সড়কে। 

যাত্রী, চালক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়কটিতে নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল করে অবাধে। এ ছাড়া বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা, তিন চাকার যানবাহনের আধিক্য, ট্রাফিক আইন না মানা ও দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ঘটনা থামছে না। 

তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরীর দাবি, এই সড়কে প্রায় সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালিত হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন জব্দ করে ধ্বংস করার জন্য পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া লাইসেন্স না পেলে চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সড়কটিতে চট্টগ্রাম নগর অংশের কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকেই বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত। এরপর কুয়াইশ, নজুমিয়া হাট, মদুনাঘাট, নোয়াপাড়া, পাহাড়তলী, শান্তিরহাট, গোডাউন, রোয়াজার হাট, মরিয়ম নগর চৌমুহনী, চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান পর্যন্ত প্রতিটি বড় মোড়েই সড়কের ওপর যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকে। এ কারণে বিভিন্ন সময় যানজটে ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। গত মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার; তিন দিন সরেজমিন ঘুরে নানা অনিয়ম দেখা গেছে।

পাহাড়তলী এলাকায় গিয়ে স্থানীয় ১০ জনের সঙ্গে সড়কের বিশৃঙ্খলা নিয়ে কথা হয়। তাঁদের একজন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চালকেরা বাঁকের মধ্যেও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। অপ্রয়োজনে ওভারটেক করেন। 

বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে চট্টগ্রাম জেলায় ৩২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়া অংশে মারা গেছেন ২১ জন। অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত কাপ্তাই সড়কে অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্তত ১৫টি ছোট–বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে এই সময়ে। 

কাপ্তাই সড়কটি এখন পুরোপুরি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি নিয়মিত এ সড়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সড়কটিতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। সব যানবাহনই বেপরোয়াভাবে চলছে।এসব তদারকির দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাও চুপচাপ।