হাইকোর্ট শুধু মাফ করার জন্য বসেননি

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

এক মামলায় আগাম জামিনপ্রাপ্ত আসামি আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক শুনানিতে পুলিশের দুই কর্মকর্তার উদ্দেশে উচ্চ আদালত বলেন, হাইকোর্ট তো শুধু মাফের জন্য বসেননি। হাইকোর্টের কাজ কি সবাইকে মাফ করে দেওয়া—যে আসেন, তাঁকেই মাফ করে দেওয়া?

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার এ কথা বলেন। জামিন সত্ত্বেও আসামি গ্রেপ্তারের ঘটনার ব্যাখ্যা জানাতে পটুয়াখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মিজানুর রহমান আজ আদালতে হাজির হন। তাঁরা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। শুনানির একপর্যায়ে আদালত ওই মন্তব্য করেন।

‘জামিন নেওয়া শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার আদালতে মুক্তি’ শিরোনামে গত ২০ মে একটি দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি পরদিন আদালতের নজরে আনেন উচ্চ আদালতে আসামিপক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী আলী আহসান মোল্লা। গত ২১ মে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন।

একইসঙ্গে ব্যাখ্যা জানাতে পটুয়াখালী থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান ও এএসআই মিজানুর রহমানকে ১৮ জুন আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ অনুসারে তারা আজ আদালতে হাজির হন।

আদালতে দুই পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ তাজরুল হোসেন ও শারমিনা হক। আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আলী আহসান মোল্লা। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন।

আদালতকে আর কত অসম্মান করবেন?

শুনানিতে আইনজীবী সৈয়দ তাজরুল হোসেন বলেন, আসামিরা (আশরাফুল হাওলাদার ও তার বাবা আবদুল লতিফ হাওলাদার) গত ১৭ মে হাইকোর্ট (এই বেঞ্চ) থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন পান। আদালত বলেন, কোন ধারায় মামলা ছিল? তখন সৈয়দ তাজরুল বলেন, দণ্ডবিধির ৩২৩, ৩২৪ ও ৩২৫ ধারাসহ কয়েকটি ধারায় মামলা।

আদালত বলেন, হাইকোর্টকে এখন ম্যাজিস্ট্রেসির কাজ করতে হয়। এসব ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন দেওয়ার কথা। হাইকোর্ট আগাম জামিন দিয়েছেন। অনলাইনে এই আদেশও দেখা যায়। তারপরও তাঁদের ধরে নিয়ে গেলেন?

আইনজীবী সৈয়দ তাজরুল হোসেন বলেন, ল ইয়ার সার্টিফিকেটও (আগাম জামিন মঞ্জুর হওয়া সংক্রান্ত) দিতে পারেননি। আদালতে নেওয়া হলে আসামিপক্ষ একটি আবেদন দেয়। তাতেও কিছু বলেনি। এর এক–দেড় ঘণ্টা পরে আরেকটি আবেদন দেয়, সেখানে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিনের কথা উল্লেখ করা হয়।

শুনানির একপর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাঁদের তিন দিনের জন্য আইনজীবীর জিম্মায় দেন।

আইনজীবী সৈয়দ তাজরুল হোসেন বলেন, জামিন পাওয়া আসামিদের জিম্মায় নেওয়ার জন্য নিম্ন আদালতে তাঁদের আইনজীবী আবেদন দেন। সে অনুসারে আইনজীবী আল–আমিন হওলাদারের জিম্মায় তাঁদের দেওয়া হয়।

আইনজীবীর উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে, আদালতও (ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) দেখতে পারতেন। কী অবস্থায় আছে—ম্যাজিস্ট্রেট অনলাইনে দেখতে পারতেন। কোর্টকে ডিসরেসপেক্ট (আদালতকে অসন্মান) আর কত করবেন? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এসব করার জন্য নয়। রাষ্ট্রের প্রতি একজন পুলিশ কর্মকর্তার সবচেয়ে দায়িত্ব; কারণ, আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করেন। উনি যদি এসব করেন—এই যে মানুষ, ১৮ কোটি মানুষ তার যে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা তা বিঘ্নিত হবে। হাইকোর্ট শুধু মাফের জন্য বসেননি। হাইকোর্টের কাজটা কি মাফ করে দেওয়া সবাইকে—যে আসেন, তাঁকে মাফ করে দেওয়া? হাইকোর্ট মাফের জন্য কিন্তু নয়।

সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন আদালত। দুই পুলিশ কর্মকর্তার আইনজীবী সৈয়দ তাজরুল হোসেন বলেন, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তাঁদের দোষ ছিল না সেভাবে। তবে আরও সতর্ক থাকতে পারতেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আলী আহসান মোল্লা বলেন, ল ইয়ার সার্টিফিকেট দিয়েছি, অথচ উনি (অপর পক্ষ) বলছেন দেখাইনি। যখন বাড়িতে এসে তাঁদের ধরে, তখন ল ইয়ার সার্টিফিকেট দেখানো হয়। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। ফোনে এসআইয়ের সঙ্গে কথা হয়। উনি বলেন ওসি স্যারের অর্ডার—ওয়ারেন্ট আছে। তখন বলেছি—এভাবে নিতে পারেন না। ফোনে কথা হয়েছে।

আদালতের প্রশ্নের জবাবে ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমার সঙ্গে কথা হয়নি। তখন আদালত বলেন, যদি মিথ্যা হয় তাহলে টেলিফোনের কল রেকর্ড তলব করা হবে।’
শুনানি নিয়ে আদালত আগামী ২৩ জুলাই পরবর্তী দিন রাখেন। সেদিন দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে উপস্থিত হতে হবে বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবী সৈয়দ তাজরুল হোসেন।

উল্লেখ্য, সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট একটি ‘কোর্ট অব রেকর্ড’ হবেন এবং তাঁর অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশদান বা দণ্ডাদেশদানের ক্ষমতাসহ আইন সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সব ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন।  

পত্রিকায় গত ২০ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পটুয়াখালী সদর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়া কলেজশিক্ষার্থী মো. আশ্রাফুল হাওলাদারকে আটক করে আদালতে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার রাতে (গত ১৮ মে) আসামির বাড়ি থেকে আটকের পর শুক্রবার (গত ১৯ মে) সকালে আদালতে পাঠানো হয়। এ সময় পুলিশকে হাইকোর্টের জামিনের কপি দেখালে তা আমলে নেয়নি বলে দাবি আসামির পরিবারের। পরিবারের অভিযোগ, আটকের পর পুলিশ মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। তা দিতে না পারায় পুলিশি ক্ষমতার বলে তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। যদিও হাইকোর্টের জামিননামা দেখে শুক্রবার দুপুরে (গত ১৯ মে) আসামি ছেড়ে দিয়েছেন পটুয়াখালী চিফ জুডিশিয়াল আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মো. জামাল হোসেন।