যমজ সন্তানের একই স্কুলে ভর্তি, অভিভাবকদের স্বস্তি
রাজধানীর সালমা আক্তার এখন হাসিমুখে যমজ মেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়া করেন। অথচ প্রথম শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় লটারিতে এক মেয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছিল জটিলতা। সালমা আক্তার বললেন, ‘মেয়ে রাইয়ান জামান যখন চান্স পেল, তখন অন্য মেয়ে রাহা জামান স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করত। প্রথম দিন স্কুলে নিয়ে গেলেও চান্স না পাওয়ায় রাহাকে পরে আর স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সে স্কুলের গেটের বাইরে কান্নাকাটি করত।’
সালমা আক্তার বলছিলেন, ‘এরপর রাহা প্রতিদিন জানতে চাইত, “আম্মু, আমি কবে স্কুলে যেতে পারব?” শেষ পর্যন্ত যখন স্কুল থেকে অনুমতি মেলে, এরপরই স্বস্তি। যমজ বাচ্চাদের অভিভাবকদের আর যাতে এই মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে না হয় এটাই চাওয়া।’
সালমা আক্তারের দুই মেয়ে পড়ছে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ধানমন্ডি শাখায় (প্রভাতি)। প্রতিষ্ঠানটির শুধু এ শাখায় এবার পাঁচ যমজ ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী লটারিতে যমজদের একজন ভর্তি হলে লটারিতে আবেদন করা অন্য ভাই বা বোনকেও ভর্তি করার সুযোগ পাচ্ছেন অভিভাবকেরা।
যেভাবে মিলল যমজদের এক স্কুলে পড়ার সুযোগ
যমজ সন্তানের একজন লটারিতে ভর্তির সুযোগ পেলে আরেকজনকে ভর্তি করার সুযোগ আসে ২০২১ সালে। ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিভাবকেরা আবেদন করেছিলেন, যাতে ১৯ জমজ শিশুর ২ জনকেই ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় যমজ শিশুদের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ নামের একজন অভিভাবসহ ১৯ অভিভাবক ওই রিট করেছিলেন।
নিজের যমজ সন্তান আছে, এ অভিজ্ঞতায় শুনানিতে রিটের পক্ষের আইনজীবী তাসমিয়া প্রধান হাইকোর্টকে বলেছিলেন, যমজ শিশুদের সুস্থ মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য একসঙ্গে থাকা খুবই জরুরি। তাদের চাওয়াপাওয়া প্রায় একই রকম। তাদের যদি আলাদা কিছু দেওয়া হয় বা আলাদা পরিবেশে রাখা হয়, তারা একধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগে।
২০২১ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্টের আদেশের পর ১৯ জমজ শিশু ২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বেসরকারি স্কুল ও কলেজে সংশোধিত শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালার ১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ঢাকা বোর্ডের নির্দেশনা এবং হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ১৯ যমজ বোনকে (যারা লটারিতে নির্বাচিত হয়নি) প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
বাদ পড়া এক সন্তানকে ভর্তিতে অভিভাবকদের যুদ্ধ
রাজধানীর বেসরকারি স্কুলে যমজ শিশুর ভর্তির বিষয়টি সুরাহা হলেও ঢাকার বাইরে কিন্তু এ সুযোগ সহজে আসেনি। সেখানেও আদালতে যেতে হয়েছে। বরিশালের যমজ এক ছেলে ও এক মেয়ের মা জীনাত লীনাকে আদালতে দৌড়াতে হয় গত বছর। তৃতীয় শ্রেণিতে ছেলেকে ভর্তি করতে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন করেও লাভ হচ্ছিল না। মেয়ে লটারিতে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর ছেলে ও মেয়ে দুজনের কান্নায় মা–বাবা অস্থির হয়ে পড়েন।
পরে হাইকোর্টে রিট করে আদালতের রায়ে ছেলেকে সরকারি স্কুলটিতে ভর্তি করতে পেরেছিলেন। জীনাত লীনা জানালেন, তাঁর স্বামী কাইয়ুম খান আইনজীবী। তিনি ছেলেমেয়ের ভর্তির জটিলতা মেটাতে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১৯ অভিভাবকের করা রিট এবং আদালতের নির্দেশের কথা জানান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষকে। তবে রাজধানীর স্কুলটি বেসরকারি, তাই সরকারি স্কুলের জন্য আদালতের সে আদেশ কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তারপর কাইয়ুম খান রিট করেন।
জীনাত লীনা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা এবার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। অথচ এই ছেলেকে কোথায় ভর্তি করব, অন্য স্কুলে দিলে ছেলেকে কে স্কুল থেকে আনা–নেওয়া করবে বা এক স্কুলে পড়তে না পারলে ছেলেমেয়েদের কান্নাই বা কে থামাবে—এসব নিয়ে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাসায় একজন বাথরুমে গেলেও তো আরেকজন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের আলাদা করলে ওদের মানসিক কোনো সমস্যা হবে কি না, সে চিন্তা তো ছিলই।
ওরা তো আর সিস্টেমের জটিলতা বোঝে না।’ স্কুলে ছেলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার পর জীনাত লীনা তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এত সংগ্রাম করে ভর্তি করা ছেলে তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ছেলেদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছে।’ ছেলে জিবরানের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন এই মা।
সরকারের নীতিমালায় অভিভাবকদের স্বস্তি
জীনাত লীনা বা অন্য অভিভাবকেরা যে যুদ্ধ করেছেন, এখন অভিভাবকদের আর সে যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষেও যমজ সন্তানের অভিভাবকেরা শুরুর দিকে কিছুটা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। এখন তাঁদের মুখে হাসি ফুটেছে।
চলতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর যমজদের ভর্তি নিশ্চিত করতে আরও উদ্যোগী হয়েছে। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সহোদর/সহোদরা বা যমজ ভাইবোনের ভর্তি সহজ করতে তিন সদস্যের যাচাই-বাছাই উপকমিটি গঠন করে। সরকারি (সব) ও বেসরকারি (মহানগরী ও জেলার সদর উপজেলা পর্যায়) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা ২০২২–এ সহোদর/সহোদরা বা যমজ ভাইবোনের ভর্তিসংক্রান্ত বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা হয়। গঠিত উপকমিটি ভর্তি নীতিমালা-২০২২ অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে সহোদর/সহোদরা বা যমজ ভাইবোনের ভর্তির আবেদন যাচাই-বাছাই করে ভর্তির জন্য সুপারিশ করে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান ভর্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সব ঠিক থাকার পরও (প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত) সহোদর/সহোদরা বা যমজ ভাইবোনকে ভর্তি করা না হলে এবং পরবর্তী সময়ে তা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দায়ী থাকবেন। অভিভাবকের করা প্রতিটি আবেদনসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। যাচাই–পরবর্তী কোনো আবেদন ভর্তির জন্য বিবেচিত না হলে তার উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানের নোটিশ বোর্ডে দিতে হবে।
যমজ সন্তানের স্কুলে ভর্তিতে যে সুযোগ আছে
গত ১৬ জানুয়ারি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির নীতিমালায় কিছুটা সংশোধন করে বলা হয়, চলতি শিক্ষাবর্ষে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শুরুর শ্রেণি (এন্ট্রি শ্রেণি) থেকে অন্যান্য শ্রেণিতে মোট আসনের অতিরিক্ত ৫ শতাংশ আসনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর ভাইবোনদের ভর্তি করা যাবে। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে ভর্তি হয়ে থাকলে বা অধ্যয়নরত থাকলে তার সহোদর, সহোদরা বা যমজ ভাইবোনদের মধ্যে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত আসনের বাইরেও ৫ শতাংশ আসনে ভর্তি করা যাবে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধানমন্ডি (প্রভাতি) শাখার প্রধান মাহমুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর শাখায় মোট পাঁচ যমজ ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। যমজ দুই বোনের দুজনই লটারিতে ভর্তির সুযোগ পায়, তবে তাদের একজন প্রভাতি ও অন্যজন দিবা শাখায় সুযোগ পেয়েছিল। এটাও অভিভাবকদের জন্য ঝামেলার ছিল। তাই তাদের দুজনকেই প্রভাতিতে ভর্তি করা হয়। অন্যদের বেলায় একজন করে লটারিতে সুযোগ পেলেও অন্যজন বাদ পড়ে গিয়েছিল।
মাহমুদ আহমদ বলেন, ‘যমজদের একজন ভর্তি হলে আর আরেকজন ভর্তি হতে না পারলে সে কোথায় যাবে—এটা অভিভাবকদের জন্য অনেক ভোগান্তির কারণ ছিল। এবার শাখাপ্রধান হিসেবে নিজেই আবেদন যাচাই–বাছাই করার সুযোগ পেয়েছিলাম। রাজধানীতে প্রতিষ্ঠানটির (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) মূল ক্যাম্পাস এবং বিভিন্ন শাখায় লটারিতে সরাসরি ২ যমজসহ মোট ১৫ যমজ ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এবার। যমজদের একসঙ্গে ভর্তির জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ, সরকারের নীতিমালা অবশ্যই ইতিবাচক। অভিভাবকদের পাশাপাশি আমরা শিক্ষকেরাও দুজনকেই ভর্তি করতে পেরে খুশি।’
বেসরকারি স্কুল, স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা-২০২২ সংশোধন করে ১৬ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে জারি করা পরিপত্রে জানানো হয়, শুধু ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি শ্রেণিসহ অন্যান্য শ্রেণিতে মোট আসনের অতিরিক্ত ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সহোদর/যমজ ভর্তির জন্য আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে ভর্তি করাতে পারবে। আবেদনের সংখ্যা বেশি হলে লটারির মাধ্যমে ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে হবে।
অভিভাবকেরা বলছেন, এই পরিপত্র ভোগান্তি বাড়াতে পারে। চলতি বছরেও ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৪১ অভিভাবককে আদালতে রিট করতে হয়। কেননা তাঁরা পরিপত্র জারির আগেই সন্তান ভর্তির আবেদন করেছিলেন। পরে প্রথম শ্রেণিতে ৪১ সহোদর ও যমজ শিশুকে ভর্তি নিতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। জানা গেছে, এই সহোদরদের মধ্যে কোনো যমজ ছিল না।