যে সরকার মামলা প্রত্যাহার করেছে, তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছি, এটা অবিশ্বাস্য: আদালতে শওকত মাহমুদ

শওকত মাহমুদপ্রথম আলো ফাইল ছবি

সরকার উৎখাতে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে রমনা মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও জনতা পার্টি বাংলাদেশের মহাসচিব শওকত মাহমুদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ডের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। রিমান্ড শুনানিতে আদালতকে শওকত মাহমুদ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে হওয়া ৭০ মামলার ৬০টি প্রত্যাহার করা হয়েছে। যে সরকার (অন্তবর্তী সরকার) আমাদের মামলা প্রত্যাহার করেছে, তাকে উৎখাতের জন্য ষড়যন্ত্র করেছি? এটা আমার জন্য অবিশ্বাস্য মনে হয়।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিনা খন্দকার আন্নার আদালতে বৃহস্পতিবার রিমান্ড আবেদন শুনানির সময় তিনি এই কথা বলেন।

গত ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয় এবং তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ৭ ডিসেম্বর এই মামলায় শওকত মাহমুদকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

আজ রিমান্ড শুনানির জন্য শওকত মাহমুদকে আদালতে এনে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাজতখানায় রাখা হয়। দেড় ঘণ্টা পর তাঁকে সিএমএম আদালতে ওঠানো হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন।

আদালতের হাজতখানা থেকে এজলাসে নেওয়া হচ্ছে শওকত মাহমুদ। ১১ ডিসেম্বর
ছবি: প্রথম আলো

আবেদনে বলা হয়, শওকত মাহমুদ এনায়েত করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগসাজস করে বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন। বর্তমান সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে এবং উচ্চপদস্থ লোকজন ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করেছেন। বিভিন্ন স্থানে গণবিক্ষোভের মাধ্যমে সরকারের সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে সরকার উচ্ছেদের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন মর্মে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। শুনানিতে আইনজীবী মো. শফিউজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ’২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের পেছনে যাঁরা মদদ জুগিয়েছিলেন, তাঁদের একজন শওকত মাহমুদ। যাঁর বিরুদ্ধে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে, তিনি একজন সাংবাদিক। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের ৫ বারের সভাপতি। ’২৪–এর আন্দোলন যারা করেছে, তাদের অন্যতম বিএনপি। তিনি বিগত ১৫ বছর বিএনপির সঙ্গে ছিলেন। এ জন্য ফ্যাসিস্টরা ওঁনাকে এত নির্যাতন করেছেন যে তাঁকে থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হারুন অর রশিদ বলেন, ওনাকে কেন রিমান্ড দেওয়া হবে না, সেই ব্যাখ্যা আসামিপক্ষ দিতে পারেনি। এ মামলা ’২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তারা পরিকল্পনা করে সরকারকে ফেলে দিতে চেয়েছে। এটার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ কাজ করেছে। ঘটনার পরপরই এ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। দীর্ঘ তদন্তের পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ মামলায় শুধু উনি না, এ মামলায় সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও জড়িত। এদের পরিকল্পনা ছিল, তাদের মনমতো একটা সরকারকে বসাবে। পরে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনবে। শওকত মাহমুদ যখন রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেছেন, তখন বিএনপি তাঁকে বহিষ্কার করেছে। রিমান্ডে নেওয়া হলে ওঁনার কাছ থেকে তথ্যউপাত্ত পাওয়া যাবে। কারা কারা ষড়যন্ত্রে জড়িত, সেটাও জানা যাবে।

আদালতের হাজতখানা থেকে এজলাসে নেওয়া হচ্ছে শওকত মাহমুদ। ১১ ডিসেম্বর
ছবি: প্রথম আলো

পরে শওকত মাহমুদ আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে দেড় বছর জেল খাটতে হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে ৭০টি মামলা হয়েছে। এই সন্ত্রাসবিরোধী মামলা দেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার যতগুলো মামলা, আমাকেও ততগুলো মামলা দেওয়া হয়েছে। আজকের সরকার আমাদের কাঙ্ক্ষিত সরকার। এই সরকার আসার পর আমার ৬০টির মতো মামলা প্রত্যাহার করেছে। যে সরকার আমার কাঙ্ক্ষিত সরকার, যে সরকার আমার আগের মামলা প্রত্যাহার করছে, তাকে উৎখাতের জন্য আমি ষড়যন্ত্র করছি? এটা আমার জন্য অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমি জীবনেও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে ছিলাম না। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিন তিনি এনায়েত করিমের ফোন যাচাই করেছেন। আমার ফোনও গত পাঁচ দিন ধরে যাচাই করছেন। এমন কোনো তথ্য ইনশা আল্লাহ এটার মধ্যে নেই, এর থেকে মনে হয়, আমি কোনো সরকার উৎখাতের সঙ্গে জড়িত আছি। আমি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম। আন্দোলনের কৌশলে আমার সঙ্গে বিতর্কের কারণে আমি বহিষ্কার হয়েছি। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার কারণে বহিস্কার হয়েছি, এটা সরকারপক্ষের মাননীয় আইনজীবী বলেছেন। এটা স্রেফ মিথ্যা।’

আরও পড়ুন

এই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার জীবনে এটা আমি বলতে পারি, সাংবাদিক হিসেবে বহু লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কিন্তু যত লোকের সঙ্গে পরিচয় থাকুক বা না থাকুক, তাদের অপকর্মে দায়ভার তো আমার ওপর আসার সুযোগ নেই। আমাকে ধরার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আমার নাম নাকি তথ্য উপদেষ্টা হিসেবে এসেছে। আমার নাম তো ইউনূস সরকার যখন গঠন করা হয়, তখনো তথ্য উপদেষ্টা হিসেবে ছিল। কারণ, তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে দলমত–নির্বিশেষে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে আমি সবার ওপরে রয়েছি। রয়েছি বলে, আমি ষড়যন্ত্র করেছি? মাননীয় আদালতের কাছে আমার প্রার্থনা, বিচার বিভাগ এখন স্বাধীন। আপনি স্বাধীনভাবে সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি অসুস্থ। আমার ছয়টা বাইপাস...লাগানো। আমি জেলখানায় অনেক কষ্টের মধ্যে আছি মাননীয় আদালত। সেখানে (কারাগারে) আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি কোনো চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারিনি। আমি আশা করব, নতুন এই প্রেক্ষাপটে আপনি ন্যায়বিচার করবেন।’

উভয় পক্ষে শুনানি শেষে শওকত মাহমুদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এরপর আদালত থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর মেয়েরা তাঁকে খাবার দিতে চান। পুলিশ সদস্যরা তাঁদের বাধা দেন। বলেন, ওঁনাকে হাজতে নিয়ে খাওয়ানো হবে।