চট্টগ্রামে মাদক মামলায় সাজার আগেই আসামি উধাও
সাত মাসে ২৪৭টি মামলার রায়ে ৫৭২ আসামির সাজা। ২৮৮ জনই রায় ঘোষণার আগে জামিন নিয়ে পলাতক।
সাড়ে চার বছর আগে চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এলাকা থেকে ৮ হাজার ৮০০ ইয়াবা বড়িসহ গ্রেপ্তার হন মিয়ানমারের নাগরিক মো. ফয়েজুল্লাহ। উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থীশিবিরে থাকতেন তিনি।
দুই বছর পর ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি কারাগার থেকে ১০ হাজার টাকার বন্ডে জামিনে মুক্তি পান। এরপর এক বছর মামলার ধার্য দিনে আদালতে হাজিরা দেন। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে পলাতক হয়ে যান ফয়েজুল্লাহ।
আদালত ফয়েজুল্লাহর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু পুলিশ তাঁর হদিস পায়নি। একপর্যায়ে এ বছরের ১৬ মে চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঁঞা এই মামলার রায় দেন। ফয়েজুল্লাহকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা দেন আদালত।
পুলিশকে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তারে আরও তৎপর হতে হবে। নইলে মাদকের আগ্রাসন কমবে না।রেজাউল করিম, আইন উপদেষ্টা, ব্লাস্ট
শুধু ফয়েজুল্লাহ নন, বেশির ভাগ আসামি জামিনে মুক্তি পেয়ে কয়েক মাস আদালতে হাজিরা দেন। এরপর পলাতক হয়ে যান। আদালত সাজা দিলেও পুলিশ আর তাঁদের খুঁজে পায় না।
আদালত সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম মহানগরসহ ১৫টি আদালতে ২৪৭টি মাদকের মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এসব মামলায় কারাদণ্ড দেওয়া ৫৭২ আসামির মধ্যে ২৮৮ জনই রায় ঘোষণার আগে জামিনে গিয়ে পলাতক হয়ে যান। এর আগে ২০২২ সালে ৩৫১ মাদক মামলায় ৮৩২ জনের সাজা হয়। এর মধ্যে পলাতক হয়ে যান ৪৮০ জন। ২০২১ সালে ২৮৬ মামলায় ৩২২ জনের সাজা হয়। আর এর মধ্যে পলাতক হয়ে যান ১৬৫ জন। পলাতক এসব আসামির বেশির ভাগই ধরা পড়েনি।
বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতগুলোতে ১৬ হাজার ৬১০টি মামলা বিচারাধীন। আসামি ফয়েজুল্লাহর জামিনের আবেদন করেছিলেন আইনজীবী ইশতিয়াক আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জামিন পাওয়ার পর থেকে ফয়েজুল্লাহ তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি। ফয়েজুল্লাহর জামিনদার লোহাগাড়া উপজেলার হামিদ হোসেন। তিনিও জানান, ফয়েজুল্লাহ কোথায় আছেন জানেন না।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, একজন আইনজীবী ও একজন স্থানীয় ব্যক্তির জিম্মায় আদালত আসামিকে জামিন দিয়ে থাকেন। আসামি পলাতক হয়ে গেলে জিম্মাদারকে শোকজ করতে পারেন আদালত। তিনি বলেন, সচরাচর কাউকে শোকজ করা হয় না। যে হারে মাদক মামলার আসামিরা জামিনে গিয়ে পলাতক হয়ে যাচ্ছেন, বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হবে।
পুলিশ জানায়, চট্টগ্রাম নগরের ১৬ থানায় প্রতিদিন গড়ে ১৬ থেকে ২০টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৮ থেকে ১০টিই মাদকের। ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন ও ফেনসিডিল উদ্ধারের ঘটনায় এসব মামলা হয়। নগরের ১৬ থানায় বর্তমানে ৫৫০টি সাজা পরোয়ানা তামিলের জন্য রয়েছে। এর মধে৵ ২৬০টি পরোয়ানা মাদকের মামলায়।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করার জন্য ১৬ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা দেন বলে জানান নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছেন তাঁরা। ধরাও পড়ছে।
র্যাব-৭ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) তাপস কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, সাজাপ্রাপ্ত দীর্ঘ ১০ থেকে ১৫ বছর পলাতক অনেক আসামিকে তাঁরা গ্রেপ্তার করেছেন। অন্য পলাতকদের ধরতে অভিযান চলছে।
জামিন নিয়ে পলাতক
আবদুল মোতালেব নামে কক্সবাজারের টেকনাফের এক মাদক ব্যবসায়ীকে গত ১১ মে ছয় বছরের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১৯ সালের ১২ জুন চট্টগ্রাম নগর থেকে তিনি আড়াই হাজার ইয়াবা বড়িসহ গ্রেপ্তার হন। পরের বছরের ২২ জুলাই তিনি ১০ হাজার টাকার বন্ডে জামিনে মুক্তি পান। এরপর প্রায় দেড় বছর আদালতে হাজিরা দেন। গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে পলাতক হয়ে যান। জানতে চাইলে তাঁর জামিনের আবেদন করা আইনজীবী আহসান উল্লাহ জানালেন একই কথা। জামিনের পর থেকে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি আসামি মোতালেব।
সাজাপ্রাপ্ত মাদক মামলার পলাতক আসামিদের হাজির করতে না পারলে জিম্মাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন আইনি সহায়তা দেওয়া সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আদালত জিম্মাদারকে কারণ দর্শাবেন। এর পরও হাজির করতে না পারলে মুচলেকার অর্থ বাজেয়াপ্ত হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫১৪ (২) ধারা বলেছে, জামিনে গিয়ে আসামি পালিয়ে গেলে জিম্মাদারের স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম আরও বলেন, আইনের এই বিধানটি চালুর পাশাপাশি পুলিশকে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তারে আরও তৎপর হতে হবে। নইলে মাদকের আগ্রাসন কমবে না।