নিশ্চিত আয়ের আশায় বিনিয়োগে ঝোঁক

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকা এখন রূপ নিয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায়। এখানে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাণিজ্যিক ভবনছবি: জাহিদুল করিম

বাণিজ্যিক আবাসন খাতে বিনিয়োগ এখন বেশ লাভজনক হয়ে উঠছে। আধুনিক ও উচ্চপ্রযুক্তির নান্দনিক নির্মাণশৈলীতে গড়া এসব স্থাপনায় একদিকে যেমন ক্রেতাদের নজর কাড়ছে; অন্যদিকে এসব স্থাপনায় বিনিয়োগ করে সবচেয়ে বেশি লাভ পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে ভাড়া থেকে আয় করছেন অর্ধেকের বেশি ক্রেতা। আর অফিস কিংবা অন্য ক্রেতাদের নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাকি অংশ বিক্রি হচ্ছে।

বিনিয়োগে লাভজনক স্থাপনা

দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের নজর এখন বাণিজ্যিক স্থাপনায়। ভালো বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে অনেকেই এখন এই স্থাপনা কিনে ভাড়া দিয়ে আয় করছেন। ফলে আগের চেয়ে ক্রেতা বৃদ্ধিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা লাভজনক হয়ে উঠছে। নতুন নতুন প্রকল্প নিচ্ছে আবাসন নির্মাতা কোম্পানি। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই খাতে ক্রেতাদের অর্ধেকের বেশি হচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী। বাকি অংশ কিনছে ব্যাংক, করপোরেট অফিস এবং বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।

বাণিজ্যিক স্থাপনা এখন ভাড়াকেন্দ্রিক আয়ের সবচেয়ে নিশ্চিত মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একদিকে করপোরেট ও বহুজাতিক সংস্থার প্রবৃদ্ধি, অন্যদিকে ই–কমার্স ও স্টার্টআপের বিস্তার—দুটি কারণেই শহরভিত্তিক অফিস স্পেসের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। ভাড়ার হার ভালো এবং দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা একাধিক ইউনিট কিনে আয়ের পরিকল্পনা করছেন।

ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। তারা বলছে, যেসব এলাকায় করপোরেট চাহিদা বেশি—গুলশান, বনানী, তেজগাঁও, উত্তরা ও পূর্বাচল—সেসব অঞ্চলে সুপরিকল্পিত কমপ্লেক্স ও সুউচ্চ ভবনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। দেশের বাণিজ্যিক স্থাপনার মূল্য ২০২৫ সাল শেষে ৭৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে—এমন পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইনসাইটস।

চাহিদায় বড় বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স ও সুউচ্চ ভবন

শেখ রবিউল হক

বড় আকারের বাণিজ্যিক ভবনগুলোর চাহিদা এখন সর্বাধিক। করপোরেট ভাড়াটেরা বেশি সুবিধা, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিকাঠামো পাওয়ায় এই ভবনগুলোতে থাকতে পছন্দ করেন। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোও ৩০–৪০ তলা ভবনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। দেশের বেশ কিছু শীর্ষ নির্মাতা ইতিমধ্যে উচ্চতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

ট্রপিক্যাল হোমস ৫০০ ফুট উচ্চতার টি এ টাওয়ারসহ পাঁচটি বড় প্রকল্প নিয়েছে। শান্তা হোল্ডিংসের উচ্চতা ও সুবিধায় সমৃদ্ধ আধুনিক বাণিজ্যিক টাওয়ারের ৬টি চলমান প্রকল্প রয়েছে। কনকর্ড রিয়েল এস্টেট দীর্ঘদিনের পুরোনো বাণিজ্যিক–আবাসিক নির্মাতা। এ ছাড়া এসইএল, বিটিআই, রূপায়ণ, ইস্টার্ন হাউজিং, শেল্​টেক্​, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বড় বাণিজ্যিক প্রকল্পে কাজ করছে। 

মতিঝিলের ৫৬১ ফুট উচ্চতার সিটি সেন্টার ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক ভবন এই প্রতিযোগিতার প্রতীক। পূর্বাচলে সরকারের পরিকল্পিত ১৪২ তলা আইকনিক টাওয়ার ভবিষ্যতের বাণিজ্যিক স্থাপনার নতুন যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ট্রপিক্যাল হোমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ রবিউল হক প্রথম আলোকে বলেন, শেয়ারবাজার, বিমা ও ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক জায়গায় এখন টাকা বিনিয়োগ–পরবর্তী মুনাফা পাওয়া যায় না। ব্যবসা করতে গেলেও নানা সমস্যায় পড়ছেন। এ কারণে কম ঝুঁকি নিয়ে বাণিজ্যিক স্থাপনায় অনেকে বিনিয়োগে আসছেন। এই নিরাপদ বিনিয়োগের আস্থা তৈরি করতে বহু বছর লেগেছে। দেশে বিনিয়োগের বিকল্প নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে এটি। তিনি বলেন, যারা ভালো ভবন তৈরি করছে, তারা ভালো বিনিয়োগ পাচ্ছে। এসব বাণিজ্যিক স্থাপনায় নিজস্ব ব্যবহারের পাশাপাশি এখন ৫০ শতাংশের বেশি ভাড়া থেকে আয় করার জন্য কিনছে। 

“নিরাপদ বিনিয়োগের আস্থা তৈরি করতে বহু বছর লেগেছে। দেশে বিনিয়োগের বিকল্প নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। যারা ভালো ভবন তৈরি করছে, তারা ভালো বিনিয়োগ পাচ্ছে।
শেখ রবিউল হক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ট্রপিক্যাল হোমস

রবিউল হক বলেন, এখন বাণিজ্যকেন্দ্রের রূপ পরিবর্তন হয়েছে। বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় এখন হোটেল–রেস্তোরাঁ ও খুচরা মার্কেট ভালোভাবে চলছে। বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ভবন এখন ২০ তলার ওপরে হচ্ছে। বর্তমানে আবাসন কোম্পানিগুলো চাহিদার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ তৈরি করতে পারছে। পদ্মা থেকে ঢাকা হয়ে ভুলতা গাউছিয়া পর্যন্ত নির্মাতা কোম্পানিকে স্থাপনা তৈরির জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। এই খাতে বেশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে। 

রবিউল হক বলেন, বাণিজ্যিক ভবন বহুতল হলেও ভয়ের কিছু নেই। এসব ভবন ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় করে তৈরি করা হচ্ছে। ক্রেতাবান্ধব এসব ভবন দোল খাবে; কিন্তু ভেঙে পড়বে না। ভালো কোম্পানিগুলো বিল্ডিং কোড মেনে স্থাপনা তৈরি করছে। ফলে ভবনের ক্ষতি হবে না। 

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে র‍্যাংকন প্রপার্টিসের বাণিজ্যিক ভবন
ছবি: প্রথম আলো

টেকসই নির্মাণ: পরিবেশবান্ধব ভবনে করপোরেট চাহিদা বেড়েছে

বাণিজ্যিক স্থাপনায় এখন সবচেয়ে বড় গুরুত্ব পাচ্ছে ‘গ্রিন বিল্ডিং’। পরিবেশবান্ধব নির্মাণকৌশল করপোরেট ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ভাড়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। গ্রিন প্রযুক্তির কিছু উল্লেখযোগ্য উপাদান—বৃষ্টির পানি সংগ্রহ–ব্যবস্থা, সোলার পাওয়ার সিস্টেম, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি), জ্বালানিসাশ্রয়ী আলোকসজ্জা ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, কম কার্বন নিঃসরণ–উপযোগী উপকরণ, তৈরি পোশাক খাতের কারখানাগুলোর গ্রিন সার্টিফিকেশন সফলতা থেকেও নির্মাতারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের নতুন ভবনকে ঢাকার প্রথম সরকারি গ্রিন বিল্ডিং ঘোষণা করেছে, যা এই প্রবণতাকে আরও এগিয়ে দেবে।

এ বিষয়ে স্থপতি কাজী গোলাম নাসির প্রথম আলোকে বলেন, আবাসন কোম্পানিগুলো এখন আধুনিক ভালো মানের প্রযুক্তিনির্ভর বাণিজ্যিক স্থাপনার উঁচু ভবন তৈরি করছে। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় নতুন করে বাণিজ্যিক স্থাপনা বেশ গড়ে উঠছে। ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে অনেক বহুতল ভবনে বাণিজ্যিক স্থাপনা হচ্ছে। 

গ্লাস মোড়ানো ভবন: নান্দনিকতা, আলো ও সাশ্রয়

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক স্থাপনায় গ্লাস ব্যবহার এখন মূলধারার ডিজাইনে পরিণত হয়েছে। আধুনিক স্থাপত্যে গ্লাস ব্যবহার বাড়ছে; কারণ, প্রাকৃতিক আলো বেশি পাওয়া যায়। তাপ কম প্রবেশ করে, ফলে বিদ্যুৎ–সাশ্রয়ী। নির্মাণে সময় ও ব্যয় কম। ভবন নান্দনিকতা আলাদা করে তুলে ধরে। চাহিদা বাড়ায় দেশি গ্লাস উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোও উৎপাদন বাড়িয়েছে। বিদেশি গ্লাসের পাশাপাশি দেশি পণ্যও বাজারে জনপ্রিয় হচ্ছে। এ গুলোর কদর ভালো।

বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে নিরাপত্তা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার

ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড বা যেকোনো দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নির্মাতারা এখন বাধ্যতামূলকভাবে দিচ্ছেন—অগ্নিনির্বাপণ প্রযুক্তি: স্প্রিঙ্কলার–ব্যবস্থা, হাইড্রেন্ট লাইন, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি, ধোঁয়া–প্রতিরোধী সিঁড়ি, ২৪/৭ স্মার্ট মনিটরিং, উন্নত নিরাপত্তা ক্যামেরা ও সাইবার সিকিউরিটি। সরকারও ভবন নিরাপত্তা সার্টিফিকেশন কড়াকড়িও বাড়িয়েছে।

বাজারমূল্য: এলাকায় দামের তারতম্য

ঢাকার বাণিজ্যিক স্থাপনার দাম ভৌগোলিক অবস্থানভেদে পরিবর্তিত হয়—গুলশান, বনানী ও তেজগাঁও: সর্বোচ্চ মূল্য। মিরপুর–বাড্ডা–উত্তরা: মধ্যম বাজেটের এলাকা। পূর্বাচল: ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়, দাম তুলনামূলক কম। প্রতি বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেসের বর্তমান বাজারদর সাধারণত ৮ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। বড় ও প্রিমিয়াম ভবনের মূল্য ১,০০০ থেকে ১,৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ থাকলেও সম্ভাবনা বড়

অর্থনৈতিক মন্দা ও নির্মাণ–বিধিনিষেধের কারণে নতুন প্রকল্পের গতি কিছুটা কমলেও দীর্ঘ মেয়াদে এ বাজার আরও বিস্তৃত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সব মিলিয়ে নিশ্চিত আয়, প্রযুক্তিনির্ভর নির্মাণ, আধুনিক নকশা এবং টেকসই প্রবণতা—এই চার কারণে বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট খাত এখন দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে দ্রুত উঠে আসছে।