হাত ধোয়ার অভ্যাস ধরে রাখতে হবে

স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইউনিসেফ ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশ যৌথভাবে হাত ধোয়া বিষয়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করে।

মো. তাজুল ইসলাম, মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী, জাইদ জুর্জি, মো. জসিম উদ্দিন

করোনাভাইরাসের সময় দেশের মানুষের মধ্যে হাত ধোয়ার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, তা ধরে রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ। করোনার প্রাদুর্ভাব কমার সঙ্গে সঙ্গে সেই অভ্যাসও কমতে শুরু করেছে। জীবাণু থেকে সুরক্ষা এবং সুস্থ জীবনের জন্য হাত ধোয়ার বিষয়টি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে হাত ধোয়াসংক্রান্ত এক জাতীয় সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইউনিসেফ ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশ যৌথভাবে এই সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে আয়োজকেরা ‘সবার জন্য হাতের স্বাস্থ্যবিধি’ শিরোনামে একটি কৌশলপত্র উপস্থাপন করেন।

সম্মেলনে বক্তারা বলেন, সমাজের সব পর্যায়ের মানুষকে হাত ধোয়ায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে সাবানসহ পরিষ্কারক পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, হাত ধোয়ার বিষয়টি বিশ্বসম্প্রদায় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। হাত পরিষ্কার যদি না রাখা হয়, তাহলে অনেক রোগব্যাধি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারব না। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন হাত ধোয়ার চর্চা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এ বিষয়টিকে এগিয়ে নিতে আয়োজিত এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, করোনার সময় হাত ধোয়ার অভ্যাসটি দেশের সংস্কৃতির মধ্যে চলে এসেছে। বিষয়টিকে অব্যাহত রাখতে হবে।

গত দুই বছরে সাবান ও এ–জাতীয় পরিষ্কারক পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান বলেন, দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা গেলে মানুষের পক্ষে এসব কিনে হাত ধোয়ার সঠিক চর্চা করা সম্ভব।

ব্যবসায়ীরা সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে মানুষকে হাত ধোয়ায় উদ্বুদ্ধ করতে ক্যাম্পেইনের আয়োজন করতে পারেন—এমন মনে করেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে যৌথভাবে কাজ করতে পারে।

বেসিন, পানি ও সাবানের ব্যবস্থা ছাড়া হাত ধোয়ার কথা চিন্তা করা যায় না। এই খাতে সরকারকে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে ইউনিসেফের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ জাইদ জুর্জি বলেন, ছাত্রছাত্রীদের হাত ধোয়ার অভ্যাস থাকলে কম অসুস্থ হয় এবং তারা পড়াশোনায় বেশি সময় দিতে পারে। সঠিকভাবে হাত না ধোয়ায় প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকে অসুস্থতার শিকার হন। যা তাঁদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। এই খাতে সরকার বিনিয়োগ করলে তা সবার জন্যই কল্যাণের হবে।

দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের জন্য পানি সরবরাহব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, হাত ধোয়া বিষয়ে একটি রোডম্যাপ করা হয়েছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এটি বাস্তবায়নের কথা জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের পলিসি সাপোর্ট অধিশাখার যুগ্ম সচিব মো. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, বঞ্চিতদের চিহ্নিত করতে পারলে সর্বজনীন হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে। সবার জন্য হাত ধোয়া নিশ্চিত করতে হলে এ–সংক্রান্ত যেসব কার্যক্রম আছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় অর্থও বরাদ্দ রাখতে হবে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে।

দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় ভাগে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হ্যান্ড হাইজিন সামগ্রী পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ে মতবিনিময় হয়। এ সময় অনুষ্ঠানে আগত দর্শনার্থীদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়। ঝালকাঠি থেকে আসা আনোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেন, করোনার আগে যে সাবানের দাম ছিল ৩৫ টাকা, সেটা এখন ৫৫ টাকা হয়ে গেছে। পণ্যের দাম যদি না কমানো হয়, তাহলে হাত ধোব কী দিয়ে?

জবাবে ইউনিলিভারের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের পরিচালক শামীমা আক্তার বলেন, হাত ধোয়ার যে উপাদানগুলো আছে, তার প্রায় ৯০ ভাগ আমদানি করা। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি করা এসব পণ্যের দাম বাড়ায় বাধ্য হয়ে মূল্য বৃদ্ধি করতে হয়েছে।

আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেডের শাইন স্যানেটারি ওয়ার অ্যান্ড ফিটিংস ও প্লাটিনাম স্যানেটারি ওয়ার অ্যান্ড ফিটিংসের হেড অব অপারেশন্স আবদুল্লাহ-আল-জুনায়েদ বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের বিদ্যুৎ–বিভ্রাট, ডলারের উচ্চমূল্য, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। এই বৈশ্বিক সংকটের কারণে অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও দাম বেড়ে যাচ্ছে।

সুযোগ-সুবিধা তৈরি ও সাবানের ব্যবস্থা না করা গেলে হাত ধোয়া সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠবে না উল্লেখ করে ওয়াটারএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করুক, সমস্যা নেই। কিন্তু দরিদ্র মানুষের উপযোগী সাবান বাজারে আনেন। যাতে তারা কম দামে জিনিস কিনতে পারেন বা সামর্থ্যের মধ্যে থাকে।

অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্য দেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উন্নয়ন অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব নুমেরী জামান। জোর করে মানুষের আচরণ পরিবর্তন করা যায় না উল্লেখ করে নুমেরী জামান বলেন, মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছাতে পারলে হাত ধোয়ার আচার-আচরণ পরিবর্তন করা সম্ভব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করা ছাড়া হাত ধোয়া কর্মসূচি সফল করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকার এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব রোকসানা আঞ্জুমান।