ক্যানসার–চিকিৎসাবিষয়ক অনলাইন আলোচনা
বাংলাদেশে নারীদের ক্যানসার: ঝুঁকি, সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার অগ্রগতি যেমন আশার আলো দেখাচ্ছে, তেমনি নারীদের ক্যানসার নিয়ে সচেতনতার অভাব এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের দেশে ব্রেস্ট ক্যানসার ও সার্ভাইক্যাল ক্যানসারের ঝুঁকি এখনো অনেক বেশি। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণের গুরুত্ব ও চিকিৎসার আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে বাস্তবসম্মত আলোচনা অত্যন্ত জরুরি।
৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। এ পর্বের বিষয় ছিল ‘নারীদের ক্যানসার এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা’। পর্বটি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
নাসিহা তাহসিনের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন আহছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন এবং ডা. অদিতি পাল চৌধুরী। বাংলাদেশে নারীদের ক্যানসারের ঝুঁকি, ধরন, ডায়াগনোসিস, চিকিৎসাব্যবস্থা, সচেতনতা এবং প্রতিরোধব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা।
শুরুতেই উপস্থাপক বাংলাদেশে নারীদের ক্যানসারের ধরন সম্পর্কে জানতে চান। উত্তরে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে যে দুটি ক্যানসার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, সেগুলো হলো ব্রেস্ট ক্যানসার ও সার্ভাইক্যাল ক্যানসার। সেই সঙ্গে নারীদের ডিম্বাশয়ের ক্যানসারেরও ঝুঁকি থাকে। ফিমেল জেনিটাল অর্গানের আশপাশেও যেকোনো ক্যানসার হতে পারে। এ ছাড়া গর্ভধারণের সময় অনেক নারীর গর্ভফুল থেকে ক্যানসার হতে পারে, যেটিকে আমরা ‘করিও কারসিনোমা’ বলি। ফুসফুস, পাকস্থলী, নাক, কান, গলা ইত্যাদির ক্যানসার নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। আর যেসব নারী তামাক কিংবা পান খান, তাঁদের ক্ষেত্রে মুখেও ক্যানসার দেখা দিতে পারে।’
নারীদের ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন বলেন, ‘একেক ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে একেক ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি খানিকটা ভয়াবহ। কারণ, প্রাথমিকভাবে এর গুরুত্ব দেওয়ার মতো কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। আর সার্ভাইক্যাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে মাসিকের সময় অস্বাভাবিক রক্তপাত দেখা দেয় এবং অস্বাভাবিক গন্ধযুক্ত সাদাস্রাব নিঃস্বরণ হতে পারে। আর মুখগহ্বরের ক্যানসারের ক্ষেত্রে অনেক সময় মুখে ঘা কিংবা ক্ষতের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রথমদিকে এগুলোকে অনেকেই তেমন গুরুত্ব দেন না। তবে যাঁরা তামাক ও পান খান, তাঁদের এসব ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।’
নারীদের ক্যানসার নিয়ে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত—এ বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. অদিতি পাল চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ক্যানসারের দুই ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। তাঁদের মধ্যে যেগুলো জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে সেগুলোকে কোনো সতর্কতা অবলম্বন করে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। তবে যে ক্যানসারগুলো পরিবেশগত কারণে হয়ে থাকে, সেগুলো সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নিজের জীবনযাত্রার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিজের খ্যাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনতে হবে। সবুজ শাকসবজি খেতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।’
ডা. অদিতি পাল চৌধুরী আরও বলেন, ‘ত্বকের ক্যানসারের হাত থেকে বাঁচতে সান প্রটেকশন ব্যবহার করা উচিত। এ ছাড়া চাপমুক্ত থাকাও জরুরি। আর চাপমুক্ত থাকতে মেডিটেশন করা যেতে পারে। পরিবারে কারও ক্যানসার হলে অন্য সদস্যদের ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই পরিবারে কারও ক্যানসার হয়ে থাকলে নিয়মিত স্ক্রিনিং করানো উচিত। সেই সঙ্গে আজকাল ক্যানসারের ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। এসব ভ্যাকসিন নিলে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসে।’
নারীদের ক্যানসারের স্ক্রিনিং নিয়ে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন বলেন, ‘রেগুলার স্ক্রিনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের ক্ষেত্রে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশে সার্ভাইক্যাল ও ব্রেস্ট ক্যানসারের হার অনেক বেশি। আর বাংলাদেশে ক্যানসারের জন্য ভালো স্ক্রিনিং প্রোটোকল বা গাইডলাইন দুটিই রয়েছে। স্ক্রিনিংয়ের সুবিধা হলো, এতে অনেক আগেই রোগটি ধরে ফেলা যায়। ফলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া সম্ভব হয়।’
ডা. অদিতি পাল চৌধুরীর মতে, বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে এখন এসব নিয়ে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও এমন অনেক রোগী আমার কাছে এসেছিলেন, যাঁরা ক্যানসারের চতুর্থ স্টেজে। কিন্তু এখন এটি অনেক হ্রাস পেয়েছে। বেশির ভাগ রোগীই এখন প্রথম কিংবা দ্বিতীয় স্টেজেই চিকিৎসা নিতে শুরু করছেন।’
ক্যানসার রোগীদের সামাজিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, ‘একজন রোগী যখন ক্যানসারে আক্রান্ত হন, প্রথমদিকে তিনি বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না যে তাঁর ক্যানসার হয়েছে। যখন তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তখন তিনি ডিপ্রেশনে চলে যান। ভাবতে শুরু করেন, এটি মরণঘাতী একটি রোগ, মৃত্যু নিশ্চিত। এই সময়ে আসলে পরিবার আর কাছের মানুষদের সাপোর্ট অনেক বেশি দরকার। এর পরও যদি ডিপ্রেশন কাটিয়ে না উঠতে পারেন তবে কাউন্সিলিং জরুরি।’
ডা. অদিতি পাল চৌধুরী আরও বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন ক্যানসার একটি ছোঁয়াচে রোগ। ক্যানসার রোগীদের আইসোলেট করে রাখেন। ক্যানসার মোটেও কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন থাকা জরুরি।’
বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে যেহেতু ব্রেস্ট ক্যানসার আর সার্ভাইক্যাল ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি। তাই যত সম্ভব এসবের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে যেহেতু কিছু ক্যানসারের লক্ষণ ঠিকভাবে প্রকাশ পায় না, তাই নিয়মিত স্ক্রিনিং করানো জরুরি। এতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। আর যত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও তত বেশি থাকে। সেই সঙ্গে আশপাশে কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে অবশ্যই তাঁকে মানসিকভাবে সাহস জোগাতে হবে।