মানুষ অনেক, ক্রেতা কম

ইতিহাসের বাঁকবদল একাত্তর ও পঁচাত্তর মহিউদ্দিন আহমদ প্রথমা প্রকাশন

এই শহরে মানুষের বেড়ানোর জায়গা খুব কম। তাই সুযোগ পেলেই কোথাও নিশ্বাস নিতে ছুটে যায়। তবে অসম্ভব ভিড়ে গতকাল শুক্রবার শ্বাস নেওয়াই কঠিন ছিল বইমেলায়। শত শত মানুষ এসেছিল ছুটির বিকেলে। বইমেলার প্রবেশমুখের তথ্যকেন্দ্রের একজন বললেন, মাথা গুনে রাখা গেলে ভালো হতো।

ঢাকা শহরের সব মানুষ মনে হয় আজকে মেলায়! এত মানুষের সমাগমে আলাদাভাবে লেখক, প্রকাশক খুঁজে বের করা ছিল অসম্ভব। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভিড় থেকে একটু দূরে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাহিত্যিক আন্দালিব রাশদী। বললেন, বন্ধুদের অনুরোধে এসেছেন। তবে ভিড় হলেও বই কতজন কিনছেন, তা নিয়ে সংশয় আছে তাঁর।

কথা সত্যি, অধিকাংশ মানুষ ছবি তুলেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু বই কম ছিল তাঁদের হাতে। মেলার ‘ক্রিয়েটিভ ঢাকা’ নামের নান্দনিক বইয়ের স্টলের মেঝেতে প্রায় শুয়ে পড়েছিল এক শিশু। সাহিত্য নামের এই শিশুর সঙ্গে এসেছে পরিবারের আরও তিনজন। শিশুটির ছবি তুলছিল তারা, কিন্তু কারও হাতেই নেই একটি বই। গতকাল অমর একুশে বইমেলার দশম দিনে নতুন বই এসেছে ২৬০টি। এ নিয়ে এবারের মেলায় নতুন বই হলো ১ হাজার২৫টি।

সক্রেটিস–প্লেটো উক্তি আমিনুল ইসলাম ভুইয়া পাঠক সমাবেশ

সকালের শিশুপ্রহরে অভিভাবকদের সঙ্গে এসে উপস্থিত হয়েছে অনেক শিশু। শেখ রাসেল শিশুচত্বরটি ছিল ওদের দখলে। বিকেলে বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ এবং জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: এস এম সুলতান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। শনিবারের সকালে থাকছে শিশুপ্রহর এবং সংগীত প্রতিযোগিতা।

শুক্রবারের ভিড়ের একটা বড় অংশই ছিল মেলাকে কেন্দ্র করে বেড়াতে আসা মানুষ। জনসমাগম বাড়লে কিছু বই অবশ্যই বেশি বিক্রি হয় বলে জানালেন অনন্যা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক। বই বিক্রি নিয়ে নিজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন তিনি। এই প্যাভিলিয়নে তখন জমজমাট দৃশ্য। লেখক ইমদাদুল হক মিলন তখন যে জীবন আমার ছিল বইটিতে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মান নিয়ে জানতে চাইলে বললেন, ‘আমাদের প্রজন্মের লেখকদের জন্য জীবিকার পাশাপাশি লেখা ছিল এক সংগ্রাম। পত্রিকার কাছ থেকে পাওয়া লেখার টাকাটা খুব দরকার হতো। এখনকার তরুণ লেখকদের সেই সংগ্রাম অনেক কম। ফলে তাদের আরও বেশি মনোনিবেশ করে লেখা উচিত।’

একজন জনপ্রিয় লেখকের এই মন্তব্য শুনে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আবার আটকে যেতে হলো ভিড়ে। তাম্রলিপির প্যাভিলিয়নে একজন তরুণ লেখকের জন্য জড়ো হয়েছেন কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। ক্রমাগত মুঠোফোনে ছবি তুলছেন লেখককে এক ফ্রেমে রেখে।

ডেভেলপমেন্ট রি–এক্সামিনড আনু মুহাম্মদ ইউপিএল

পাঠক সমাবেশের স্বত্বাধিকারী সাহিদুল ইসলাম অবশ্য মেলা নিয়ে অনেক আশাবাদী। বললেন, বই উপলক্ষ করে এই যে এত মানুষ আসছে, এরও মূল্য কম নয়। আজ না কিনলেও একদিন কিনবে। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হোক মানুষের। বেশ কয়েকটি নতুন বই এসেছে পাঠক সমাবেশে। বেশ কয়েকজন পাঠক এসে খুঁজলেন সক্রেটিস-প্লেটোর উক্তি বইটি।

পাশের প্যাভিলিয়নটাই প্রথমা প্রকাশনের। সেখানে অপেক্ষা করছিল এক দৃশ্য। প্রদর্শনী টেবিলে মাথা রেখে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছে এক শিশু। কেননা তার বড় ভাইয়ের যেন বই দেখা শেষই হচ্ছে না। পাশেই ভ্রুক্ষেপহীনভাবে পাওয়ারের চশমা চোখে দিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে বই দেখছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র অনাবিল নিসর্গ।

ওদের বাসা টিকাটুলীতে। অনাবিল রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের ছাত্র। বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে খেলা প্রসঙ্গে ছয়টি বই কিনে প্রথমার দোকান থেকে খুঁজে বের করেছে ফুটবল ইতিহাসের খণ্ডচিত্র এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো বইটি।

দ্য ম্যান হু কাউন্টেড অনুবাদ: আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ প্রথমা প্রকাশন

পাশের আরেক খুদে পাঠকের পছন্দ হলো একই প্রকাশনীর দ্য ম্যান হু কাউন্টেড বইটি। আর মাঝবয়সী একজন পাঠক জানতে চাইলেন মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ইতিহাসের বাঁকবদল একাত্তর ও পঁচাত্তর বইটি এসেছে কি না। এত ভিড়েও কিছু মানুষ যে সত্যি বই ভালোবাসে, তা বিশ্বাস হয় টুকরো টুকরো এই দৃশ্যগুলোতে।

মানুষের সমাগমে বদলে গিয়েছিল বাংলা একাডেমির চত্বরও। বইমেলার অধিকাংশ দিনে এখানে পাঠকের উপস্থিতি খুব বেশি হয় না। শুক্রবার সেখানেও ছিল অনেক মানুষ।