সরকার চাল কেনে ৪২ টাকায়, ভোক্তা ৫২

  • এবার আমন ১ কোটি ৭০  লাখ ও বোরো ২ কোটি ১৫ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে।

  • সরকারি গুদামে চাল–গম মজুত ১৯ লাখ টনের বেশি।

  • বিশ্ববাজারে গত এক মাসে চাল টনপ্রতি ১০ ডলার, গম ২৫ ডলার কমেছে।

চাল
ফাইল ছবি

সরকার গত আমন মৌসুমে ৪২ টাকা কেজি দরে পাঁচ লাখ টন চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছিল। খাদ্য অধিদপ্তর সেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল সংগ্রহ করেছে। চালকলমালিকেরা এ দামেই সেই চাল সরবরাহ করেছেন। অথচ বাজারে এই মোটা চালই বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে। সরকারকে কম দামে দিলেও চালকলমালিক ও ব্যবসায়ীরা বাজারে বেশি দামে এ চাল বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, আমনের পর এবার বোরোর ফলনও ভালো হয়েছে। এবার আমন ১ কোটি ৭০ লাখ, বোরো ২ কোটি ১৫ লাখ টন ও আউশ ৩০ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার প্রায় পাঁচ লাখ টন বেশি বোরো উৎপাদিত হয়েছে। এ অবস্থায় দেশের বাজারে চালের সংকট থাকার কথা নয়।

 বৈশ্বিক চালের বাজারের অবস্থাও একই। চলতি মাসের শুরু থেকে বিশ্বের প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে চালের দাম কমেছে। আর রাশিয়া ও ইউক্রেনে চালের চেয়েও বেশি কমেছে গমের দাম।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা—এফএওর চলতি মার্চের বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের মূল্যবিষয়ক প্রতিবেদেনও দুই মাস ধরে চাল–গমের দাম কমার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেশে দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই; বরং গত এক মাসে আটার দাম সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে। আর মোটা চালের কমছেই না।

খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চলতি মাসে প্রকাশিত খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে প্রধান প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে চাল ও গমের দাম কমার কথা বলা হয়েছে। সরকারি আরেক সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ—টিসিবির তথ্য বলছে, দেশে চালের দাম কমছে না। গমের দাম বাড়ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চালের দাম বেশি থাকার প্রভাব খোলাবাজারে চাল—ওএমএসের ট্রাকের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ভোর থেকে সেখানে শত শত মানুষ কম দামে চাল কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন। এর অর্থ বাজার থেকে চাল কেনার সামর্থ্য নেই এসব গরিব মানুষের।

গরিবের ৩৯ শতাংশ ব্যয়ের ধাক্কা

গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা স্টার্ট ফান্ডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের দরিদ্র অঞ্চলের মানুষের পারিবারিক আয়ের ৩৯ শতাংশ খাবার কেনায় ব্যয় হয়। আর ওই খাবারের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় চাল কিনতে। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব দরিদ্র মানুষ পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দেয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি—ডব্লিউএফপির খাদ্য পরিস্থিতিবিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেওয়ার চিত্র উঠে এসেছে।

এফএওর আরেক প্রতিবেদনে গত ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে চাল ও গমের দামের ওঠানামা একটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, ২০২২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে চাল ও আটার দাম সামান্য কমেছে। প্রতিবেদনে চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের বাজারে চালের দাম কমতির দিকে দেখানো হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট—বিআরআরআইয়ের মহাপরিচালক শাহজাহান কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার প্রতি কেজি ৪২ টাকা দরে চাল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংগ্রহ করেছে। ওই চাল তো দেশের চালকলমালিকেরাই দিয়েছেন। বাজারেও তাঁরাই চাল সরবরাহ করেন। তাহলে কেন বাজারে মোটা চালের কেজি ৪৮ থেকে ৫২ টাকা? আমাদের গবেষণায় দেখেছি, চালকলমালিকেরাই মাত্রারিক্ত দাম বাড়িয়ে মুনাফা করছেন।’

দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, বিশ্ববাজারে গত এক সপ্তাহে চালের দাম কমেছে। মাস ও সপ্তাহ অনুযায়ী ভারত, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে চালের দামের তুলনামূলক একটি চিত্র দেখানো হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, এসব দেশে প্রতি টন চালের রপ্তানিমূল্য এক মাসে ৫ থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত কমেছে। অন্যদিকে গমের দাম টনে কমেছে ২৫ ডলার।

দেশে উৎপাদন ভালো, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম পড়তির দিকে—তারপরও দেশে চালের দাম বাড়ছে কেন, এমন প্রশ্নে দেশের চাল ব্যবসায়ীদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো, হাসকিং, মিল ও মেজর চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমরা পাইকারিতে মোটা চাল ৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। ওই চাল কীভাবে বাজারে ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারা বেশি দামে বিক্রি করছে, বেশি মুনাফা করছে, তা সরকার খুঁজে বের করুক।

আবদুর রশিদ মন্তব্য করেন, সরকার বিদেশ থেকে ৪৭ টাকা কেজি দরে চাল কেনায় দেশের খুচরা বাজারে প্রভাব পড়তে পারে।

মজুত ভালো

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, আমন মৌসুমে সরকার পাঁচ লাখ টন চাল ও তিন লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ টন চাল সংগ্রহ হয়ে গেছে। সরকারি গুদামে এখন চাল ও গমের মজুত ১৯ লাখ টনের বেশি।

এ ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গুদামে যথেষ্ট পরিমাণে চাল আছে। আপাতত আমরা নতুন করে আর সরকারি খাতে চাল আমদানি করছি না। দেশেও চালের উৎপাদন ভালো। আমাদের সংগ্রহ ভালো হচ্ছে। তারপরও কেন চালের দাম বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখে কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দেশের ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ—ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এক দল ব্যবসায়ী বছরের পর বছর কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে ভোক্তাদের কাছে অনেক বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন। সরকারি সংস্থাগুলোর তদন্তে তা বেরিয়েও এসেছে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এটা দেশের দরিদ্র মানুষের প্রতি চরম অন্যায়।