আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ। এরই মধ্যে লোহার শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ছেন একজন মানুষ। কখনো থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। কয়েকটি গর্ত আগেই খুঁড়েছেন—তাতে আংশিক পুড়ে যাওয়া বাঁশ, তক্তা আর কাঠ পুঁতে তোলার চেষ্টা করেছেন একটি ঘরের কাঠামো। অঙ্গার হওয়া টিনগুলো জোড়াতালি দিয়ে বাঁধছেন সেই কাঠামোতে।
লোকটির নাম রফিকুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তির বউবাজার এলাকায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মঙ্গলবারের আগুনে রফিকুল ও তাঁর স্ত্রী বিলকিস আক্তারের মাত্র ৮০ বর্গফুটের ঘরটি মুহূর্তে ছাই হয়ে গেছে। বস্তির পানির ট্যাংক অংশে ছিল তাঁদের ছোট্ট সংসার।
কথা বলতে বলতে রফিকুল জানালেন, তিনি ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাড়ায় চালান। স্ত্রী বিলকিস গুলশানের একটি বাসায় কাজ করেন। দুজনই সারা দিন বাইরে থাকেন বলে তাঁদের দুই সন্তানকে গ্রামের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে নানা-নানির কাছে রেখেছেন।
আগুন লাগার দিন ঘরে ছিলেন বিলকিস। রফিকুল ছিলেন বাইরে। হঠাৎ আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্ত্রী কোনো রকমে টেলিভিশন আর গ্যাসের সিলিন্ডার সরাতে পেরেছিলেন। বিছানা, কাপড়চোপড়, হাঁড়িপাতিল—সংসারে যা কিছু ছিল, সবই পুড়ে গেছে। সেদিন রাতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল বাড্ডায় ছোট ভাইয়ের বাসায়। এখন কোনোমতে পুড়ে যাওয়া টিন দিয়েই ছাউনি আর বেড়া দিয়ে থাকার জায়গা তৈরির চেষ্টা করছেন।
দুপুরে কড়াইল বস্তির বউবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বস্তিবাসীরা নিজ নিজ ঘরের জায়গায় আগুনে পুড়ে যাওয়া টিন, কাঠ, কয়লা, আসবাব সরাচ্ছেন। কেউ কেউ পরিষ্কার করছেন অবশিষ্ট ছাই-কয়লা। অনেকে পলিথিন-ত্রিপলের অস্থায়ী ছাউনি বানিয়েছেন। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে দিয়েছেন পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের জন্য।
বস্তির বাসিন্দারা জানান, জরুরি ভিত্তিতে তাঁদের খাবার ও শীতবস্ত্র প্রয়োজন। কারণ, আগুনে তাঁদের সহায়–সম্বল সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অনেকে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন। মাস শেষ হওয়ায় অনেকের হাতে টাকাপয়সাও নেই। ঘরে থাকা হাঁড়ি–পাতিল, চুলা সব পুড়ে গেছে। রান্না করে খাওয়ারও উপায় নেই।
খোকন আলী দুই বছরের নাতিকে নিয়ে পুড়ে যাওয়া একটি ঘরে টানানো ত্রিপলের ছায়ায় বসে ছিলেন। এক টুকরা টোস্ট বিস্কুট হাতে নিয়ে খাচ্ছিল শিশুটি। পাশে বসে নাতিকে দেখভাল করছিলেন খোকন।
খোকন প্রথম আলোকে বলেন, যে জায়গায় বসে আছেন, সেখানে বড় ছেলের ঘর ছিল। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাছেই আরেকটি ঘরে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন তিনি। ওই ঘরটাও পুড়ে গেছে।
ত্রাণসহায়তা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে খোকন বলেন, ‘এক লাইনে দিলে আরেক লাইনে দিতাছে না। এনু-উনু কইরা দিয়া চইলা যাইতাছে। কেউ পাইতেছে, কেউ আবার পাইতেছে না। কোনো কিছুরই ঠিক নাই।’ সকালে সাতজনের জন্য চারটি কলা, তিনটি রুটি আর তিনটি ডিম পেয়েছেন। দুপুরে কিছু পাননি বলে জানান তিনি।
খোকনের সঙ্গে আলাপকালে কাছেই জটলা পাকানো লোকজনের হট্টগোল কানে আসে। এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, এক স্বেচ্ছাসেবক কিছু খাবারের প্যাকেট বিতরণের চেষ্টা করছেন। সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি। যে যেভাবে পারছেন, হাত বাড়িয়ে খাবারের প্যাকেট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ওই স্বেচ্ছাসেবককে বিরক্ত হয়ে বলতে শোনা যায়, এভাবে করলে কাউকে দেওয়া হবে না। কিন্তু তাঁর কথা কেউ শুনছিলই না।
আগুনে পুড়ে যাওয়া বউবাজার বস্তির বরিশাল পট্টি এলাকায় গিয়ে কথা হয় রিয়াজ হাওলাদারের সঙ্গে। কড়াইলের ছোট ঘাট এলাকায় নৌকা চালান তিনি। সাত বছর বয়স থেকে কড়াইল বস্তিতে আছেন। এখন তাঁর বয়স ৪৬ বছর। ৩৯ বছরে তিনি তিনবার (২০০৪, ২০১৭ এবং এই বছর) ভয়াবহ আগুনের মুখোমুখি হয়েছেন। তিনবারই তাঁদের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এবারের আগুনেও কিছুই রক্ষা করতে পারেননি জানিয়ে রিয়াজ বলেন, ‘কেউ ঘরে ছিল না। আমি ঘাটে নৌকা চালাচ্ছিলাম। খবর শুনে দৌড়ে আসি। আসতে আসতেই দেখি ঘরে আগুন ধরে গেছে। কিছুই বাইর করতে পারিনি। আগুন নিভার পর আইসে দেখি সব পুইড়া ছাই।’
পোড়া টিন, লোহালক্কড় সরাতে গিয়ে অনেকের হাত-পা কেটে যাচ্ছে, অনেকের পায়ে পেরেক বিঁধছে। এসবের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প বসিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দল। বস্তিতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের একাধিক মেডিকেল ক্যাম্প দেখা গেছে। ছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ট্রাস্টও। চিকিৎসকেরা কাটাকাটির জন্য ব্যান্ডেজ লাগিয়ে টিকা দিচ্ছিলেন। ঠান্ডা, সর্দি–কাশির ওষুধও দেওয়া হচ্ছিল বস্তিবাসীদের।
কমিউনিটি হাসপাতাল ট্রাস্টের প্রকল্প ব্যবস্থাপক শাহাদাৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেশি রোগী আসছে হাতে–পায়ে কেটে যাওয়া, ছিলে যাওয়া নিয়ে। অনেকের পায়ে পেরেক বিঁধছে। তাদের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে টিটেনাসের টিকা দেওয়া হচ্ছে। শিশু ও বয়স্করা সর্দি-কাশি নিয়ে আসছে। ঘর পুড়ে যাওয়া অনেকের ঠান্ডাজনিত রোগবালাই হচ্ছে।