খাল নিয়ে ‘খামখেয়ালির’ খেসারত ১৩ কোটি টাকা

বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ শতবর্ষী একটি খাল ‘আইন না মেনে’ ভরাট করেছে। এখন আবার খনন করতে হচ্ছে।

খাল ভরাট করে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে বেপজা। এখন খালটি আবার খনন করতে হচ্ছে তাদের। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে।
ছবিঃ প্রথম আলো

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে শতবর্ষী একটি খাল ভরাট করে এখন আবার খনন করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। ভরাট করতে তাদের ব্যয় হয়েছিল তিন কোটি টাকা। এখন আবার খনন করতে ব্যয় হবে ১০ কোটি টাকা।

বেপজার বিরুদ্ধে অভিযোগ, খালটি ভরাট করার ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) মহাপরিকল্পনা ও তাদের সঙ্গে করা চুক্তির শর্ত মানেনি। আইনও ভেঙেছে। পরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে বেপজা ভরাট করা খালটি আবার খননের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে।

চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীতে ৩০ হাজার একরের বেশি জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। সেই শিল্পনগরের ভেতর কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) করা হচ্ছে, যার একটি বেপজার। জমির পরিমাণ ১ হাজার ১৫০ একর। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যই খাল ভরাট করেছে বেপজা।

খালটির নাম ডাবরখালী। এর দৈর্ঘ্য প্রায় সোয়া ছয় কিলোমিটার। প্রস্থ কোথাও ২০ ফুট, কোথাও ৪০ ফুট। খালটির শুরু মিরসরাই উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের চরশরৎ গ্রামে। ওই গ্রামের এক পাশে পাঁচ হাজার একরের মতো নিচু কৃষিজমি রয়েছে। সেই জমির পানি খালটি হয়ে বঙ্গোপসাগরে নিষ্কাশিত হয়। ওই জমিতে বর্ষায় ধান এবং বছরের অন্য সময় রবিশস্য, সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বঙ্গোপসাগরের কাছে খালের ওপর পুরোনো একটি স্লুইসগেট রয়েছে। সেখান থেকে সমুদ্র পর্যন্ত অংশের পানি লবণাক্ত থাকে। বাকি অংশের পানি মিঠা। খালের মিঠা পানির অংশে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। ইছাখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল মোস্তফা প্রথম আলোকে জানান, ২০১৮ সালে খালটির দুই কিলোমিটার অংশ খনন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

বেপজা খালের সোয়া দুই কিলোমিটার ভরাট করেছে ২০২১ সালে। বড় অংশ ভরাট করে ফেলায় খালটি এখন মৃতপ্রায়। ৪ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডাবরখালী খালের শুরুর এক কিলোমিটার আর শেষ দিকের তিন কিলোমিটারের অস্তিত্ব আছে। মাঝখানের সোয়া দুই কিলোমিটার খাল বালু দিয়ে ভরাট করা।

খাল ভরাটের প্রতিবাদে ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি ওই এলাকায় মানববন্ধন করেন প্রায় ১ হাজার কৃষক। কৃষকদের অভিযোগ, খাল ভরাটের কারণে বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষিজমির একাংশে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। যাঁরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁরা এখন মাছ একেবারেই কম পাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খালটি ভরাট করা ঠেকাতে তখন আন্দোলন করেও লাভ হয়নি।

‘বেপজা আইন ভঙ্গ করেছে’

দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ করছে বেজা। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার দায়িত্বও তাদের। এই শিল্পনগরের বড় অংশজুড়ে ভূমি উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে। বেশ কিছু শিল্পকারখানাও সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেজা বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের যে মহাপরিকল্পনা করেছে, সেখানে সব কটি খাল রক্ষার কথা বলা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে খাল আছে সাতটির মতো। এর মধ্যে তিনটি বড়—বামনসুন্দর, ইছাখালী ও ডাবরখালী। বেজা বলছে, তারা যেসব জায়গায় ভূমি উন্নয়ন করছে, সেখানকার খাল রক্ষা করেই বালু ফেলা হচ্ছে। ডাবরখালী খালের প্রাকৃতিক প্রবাহ ঠিক রেখে সড়ক তৈরির জন্য তারা এক কোটি টাকা ব্যয় করে একটি সেতুও নির্মাণ করেছিল। তবে খাল ভরাট করায় সেতুটির অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। একই কারণে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বর্ষার সময় পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা একটি স্লুইসগেটও।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাল ভরাট করে বেপজা বড় ধরনের ভুল করেছে। তারা আইন ভঙ্গ করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় খালটি পুনরায় খনন করতে তাদের নির্দেশ দিয়েছে। আমরাও তাগিদ দিয়েছি। তারা রাজি হয়েছে খালটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে।’

বেপজা শুধু বেজার মহাপরিকল্পনা ও চুক্তির শর্তই ভঙ্গ করেনি, তারা খালটি ভরাট করার মাধ্যমে পানি আইনও ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পানি আইনে (২০ নম্বর ধারা) বলা হয়েছে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা জলাধার ভরাট করে জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ বা তার প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না।

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আইন লঙ্ঘন করে সরকারেরই একটি সংস্থা এভাবে একটি খাল ভরাট করে ফেলবে, এটা বড় ধরনের অপরাধ। জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি।

বেপরোয়া ‘মনোভাব’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খালটি ভরাট করার ক্ষেত্রে বেজা আপত্তি জানিয়েছিল। তবে বেপজার কিছু কর্মকর্তা বেপরোয়া মনোভাব দেখিয়েছিলেন। তাঁরা খালটি ভরাট থেকে সরে আসেননি। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশেই খালটি খনন করার সিদ্ধান্ত নেয় বেপজা। উল্লেখ্য, বেজা ও বেপজা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। বেজার বর্তমান কর্মকর্তারা খালটি নতুন করে খনন করার বিষয়ে ইতিবাচক।

খাল যখন ভরাট করা হয়, তখন বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন হাফিজুর রহমান। তিনি এখন অবসরে। যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে এখন কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

নথিপত্র বলছে, খালটি আবার খনন করতে গত ৩১ জানুয়ারি দরপত্র আহ্বান করে বেপজা। আগামী ২ মার্চ দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। খালটি খননে যে ১০ কোটি টাকা ব্যয় হবে, তা বেপজা নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করবে। আগে ভরাট করতে ব্যয় করা তিন কোটি টাকাও বেপজার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে।

বেপজা বলছে, খালটি ভরাট করার সময় তাদের লক্ষ্য ছিল, পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে ছোট নালা তৈরি করা হবে। সেটির সংযোগ থাকবে তিন কিলোমিটার দূরের বামনসুন্দর খালের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, খালটি আঁকাবাঁকা হওয়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যাঘাত ঘটছিল। তাই ভরাট করা হয়েছিল। তবে সরকারের নির্দেশে আবার খনন করা হবে।

নতুন করে খননে যে ১০ কোটি টাকা ব্যয় হবে, সেটাকে অপচয় বলতে নারাজ এনামুল হক। তিনি বলেন, খালটি আঁকাবাঁকা ছিল। এখন খনন করা হবে সোজা করে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, খাল ভরাট করে নালা তৈরি করা এবং সেই নালা আরেকটি খালের সংযুক্ত করে দেওয়ার চিন্তাটি অদূরদর্শী। কারণ, বর্ষা মৌসুমে বামনসুন্দর খালই পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনে সক্ষম নয়। আরেকটি খালের পানি সেই খাল দিয়ে সাগরে নিষ্কাশন করার চিন্তা ভুল। উল্লেখ্য, খালটি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জীবন কুমার সরকারকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারাও খালটি নতুন করে খননের সুপারিশ করেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, খাল ভরাটে যে টাকা ব্যয় হয়েছে, খনন করতে যা ব্যয় হবে, তা দিন শেষে জনগণের অর্থ। বেপজা জনগণের অর্থ দিয়ে জনগণের খালটি ভরাট করেছিল, এখন আবার জনগণের টাকা দিয়ে খনন করছে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ব্যয়ের অর্থ আদায় করা উচিত।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর মিরসরাই প্রতিনিধি]