মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায় পর্যন্ত পাকিস্তানিরা আশা করেছিল, চীন হয়তো তাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরে মধ্যস্থতা করে তাদের সেই আশা আরও প্রবল হয়েছিল। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, পাকিস্তানের প্রধান লক্ষ্য ও শেষ পর্যন্ত প্রবল আশা ছিল, যা তারা প্রকাশ্যে দেখাচ্ছিল, তা হলো চীন শেষ পর্যন্ত তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। কিন্তু এটি ছিল একটি তামাশা। কারণ, চীনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা সামরিকভাবে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে না। সব ধরনের কূটনৈতিক সহায়তা দেবে।
রোববার দ্য ডেইলি স্টার মিলনায়তনে ‘মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক ইতিহাস’ শীর্ষক আলোচনায় অধ্যাপক রেহমান সোবহান এই মন্তব্য করেন।
ডেইলি স্টার ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় ও ব্যক্তির অবদান তুলে ধরতে ‘ইতিহাস আড্ডা’ শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার আয়োজন করেছে। এটি ছিল সপ্তম আয়োজন। কবি ইমরান মাহফুজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচক ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও অধ্যাপক নাভিন মুর্শিদ। অসুস্থতার কারণে আরেক আলোচক গবেষক–সাংবাদিক মঈদুল হাসান আসতে পারেননি।
চীনের তামাশা, যুক্তরাষ্ট্রের নাটক
অধ্যাপক রেহমান সোবহান মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, চীন পাকিস্তানের সঙ্গে যে তামাশা করছিল, সেই নাটক সাজিয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। চীনকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, যেন তারা যুদ্ধে যোগ দেয়। চীন যখন যুদ্ধে আসছিল না, তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর হুমকি দেয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের নৌবহরকে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি লক্ষ করতে নির্দেশ দিয়েছিল। সপ্তম নৌবহর আর আসেনি। এর পরিণতিতেই নিয়াজির চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান আলোচনা শুরু করেন মাত্র ২০ বছর বয়সে তাঁর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের স্মৃতিচারণা করে। মুক্তিযুদ্ধের পেছনের বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক লড়াইকে তুলে ধরেছেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচার চালান, যার মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাহায্য বন্ধ করা।
রেহমান সোবহান বলেন, জাতিসংঘে নানাভাবে যুদ্ধবিরতির চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও ভারতের লক্ষ্য ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন। যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে গিয়ে পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে চূড়ান্ত ভুল করে। শেষ পর্যন্ত ভুট্টোর নাটকীয় আচরণ ও চীনের নিষ্ক্রিয়তার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তাঁর মতে, এই পুরো প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক প্রচার, সাহায্য বন্ধের কৌশল এবং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নির্ধারক হয়ে ওঠে।
এত আত্মত্যাগের পরেও কেন এত বিভক্তি
আলোচনায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬১-এর রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ৬ দফা থেকে অসহযোগ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সারসংক্ষেপ শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি এই আলোচনায় দেখিয়েছেন মাতৃভাষার আন্দোলন কেমন করে ধাপে ধাপে স্বাধিকার ও চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীনতার অভিমুখে অগ্রসর হয়েছে। আলোচনায় তিনি ষাট দশকে প্রগতিশীল শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকেরা যে বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীল ভূমিকা রেখেছিলেন, তার উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গক্রমে আসে সেই সময় বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে চলতে থাকা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন কীভাবে এ দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল, সেই বিষয়গুলো।
আলোচনার শেষে মতিউর রহমান প্রশ্ন রাখেন, ‘এত প্রাণের আত্মত্যাগ, এত রক্ত, এত মা-বোনের সম্ভ্রম, এত সম্পদহানির ভেতর দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হলো, তার পরেও কেন আমরা একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পেলাম না। কেন এখনো এত বিভেদ, বিভক্তি?’ তরুণ গবেষকদের তিনি এ বিষয়গুলোর প্রতি অনুসন্ধানী দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান।
স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব নিয়ে সংশয় নেই
আলোচনায় অধ্যাপক নাভিন মুর্শিদ বলেন, অনেক সময়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব নিয়ে শঙ্কার কথা বলা হয়ে থাকে। তবে প্রবীণদের মধ্যে এমন উদ্বেগ থাকলেও স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের মধ্যে তুলনামূলকভাবে এ নিয়ে তেমন উদ্বেগ নেই। কারণ, বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান, তাতে এ দেশ কেউ দখল করবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া বিপুল মুসলিম জনসংখ্যাসহ কে এই দেশ দখল করতে যাবে। আগের মতো ঔপনিবেশিকভাবে কেউ দেশের ভূমি দখল করবে না। তবে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার প্রভাব সৃষ্টি করার প্রবণতা শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে থাকবে বলে তিনি মনে করেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দেশে শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়টি উল্লেখ করে নাভিন মুর্শিদ বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে লক্ষ্যে শিক্ষাবিদদের হত্যা করে দেশকে পিছিয়ে দিতে চেয়েছিল, তার দীর্ঘস্থায়ী একটা প্রভাব এখনো রয়েছে। এখনো আমরা ভালো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি।’
স্বাগত বক্তব্যে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের আরও ভালোভাবে জানা দরকার। আরও গভীর গবেষণা প্রয়োজন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ঘটনাবলির ইতিহাস নিয়ে বেশি আলোচনা হয়নি। অথচ এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ নিজের অভিজ্ঞতার একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তখন তিনি কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। সে সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার চীন সফর করেন। সেই সংবাদ সারা বিশ্বে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কলকাতায় অমৃতবাজার পত্রিকায় বিশাল শিরোনাম দিয়ে ছাপা হয়েছিল সেই খবর।