৮৩ হাজার কারাবন্দীর জন্য চিকিৎসক ৪ জন

ভিআইপি বন্দীরা বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসা পেলেও সাধারণ কয়েদিদের ভাগ্যে যথাযথ চিকিৎসা জোটে না।

  • মোট ৬৮ কারাগারে ১৪১ চিকিৎসক পদের ১৩৭টিই খালি।

  • প্রতিটি কারাগারে একটি পদ থাকলেও কোনো কারাগারে নেই মনোরোগ চিকিৎসক।

  • তাৎক্ষণিক যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে কোনো কোনো কারাবন্দীর মৃত্যু হয়।

দেশের কারাগারগুলোতে প্রায় ৮৩ হাজার বন্দী রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র চারজন। ভিআইপি বন্দীরা কারাগারের বাইরে কিছু হাসপাতালে সেবা নিতে পারলেও সাধারণ বন্দীদের বেশির ভাগের ভাগ্যে চিকিৎসা জোটে না। এভাবে আরেক ধরনের ‘নির্যাতন’ বা ‘শাস্তি’ ভোগ করতে হচ্ছে তাঁদের। এতে অনেক সময় কয়েদির মৃত্যু হচ্ছে। আবার আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।

কারাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চিকিৎসকদের ‘প্রেষণে’ বা ‘সংযুক্ত’ করে কারা হাসপাতালে পাঠানো হলে তাঁরা থাকতে চান না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কারাগারে চিকিৎসকদের নিয়োগ দিলেও তাঁরা যোগ দিচ্ছেন না। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, কারাগারে চিকিৎসকের পদ ‘প্রমোশনাল’ পদ নয়। নেই সুযোগ-সুবিধা। আছে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্ব। তাই তাঁরা সেখানে কাজ করতে চান না।

অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
যে দেশে গরিব মানুষের অধিকার নেই, সেখানে রাষ্ট্র কারাবন্দীদের পেছনে টাকা খরচ করবে, তা চিন্তাও করা যায় না।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দেশের ১০টি কারাগারে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় সব কারাগারেই বন্দীরা মানসিক ও শারীরিক সমস্যা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ঠিকমতো চিকিৎসা পান না। পেলেও তা নামমাত্র।

কারাগারের নিয়মানুযায়ী, প্রতিটি কারাগারে একজন মনোরোগ চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কোনো কারাগারে এই চিকিৎসক নেই। অথচ কারাবন্দী রোগীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং (পরামর্শ) ও বিশেষায়িত চিকিৎসা দরকার। নেই প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো চিকিৎসক। অন্যদিকে কারাগারের প্রায় তিন হাজার নারী বন্দী থাকলেও তাঁদের গাইনিসহ অন্যান্য রোগের কোনো চিকিৎসকই নেই। এ অবস্থায় অসুস্থ বন্দীদের স্থানীয় বা বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হচ্ছে। ফলে বন্দী নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করছি। এবার আমরা নিজেরাই ইউনিট গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছি।’

১৪১ চিকিৎসক পদের ১৩৭টিই খালি

সারা দেশের কারাগারগুলোতে মোট বন্দীর ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন। তবে এখন বন্দীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি, প্রায় ৮২ হাজার ৭৬৬ জন। কারাবন্দী রোগীদের প্রায় অর্ধেক যক্ষ্মা, টাইফয়েড, কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন। তাঁদের ধারাবাহিক চিকিৎসা লাগে। এসব বন্দীর চিকিৎসায় অনুমোদিত চিকিৎসক আছেন মাত্র চারজন।

জানা গেছে, দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয়, ৫৫টি জেলা কারাগারসহ মোট ৬৮টি কারাগার রয়েছে। এসব কারাগারের জন্য অনুমোদিত চিকিৎসক পদ রয়েছে ১৪১টি। অথচ দীর্ঘদিন ধরে ১৩৭টি পদ খালি পড়ে আছে। কারা কর্মকর্তারা বলছেন, চিকিৎসক-সংকটের কারণে ঝুঁকি নিয়ে প্রায় প্রতিদিন দুর্ধর্ষ আসামিদের বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, এই কারাগারে প্রায় ১০ হাজার বন্দীর বিপরীতে চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। সেখানেও চিকিৎসক আছেন একজন।

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন ডেপুটি জেলার বা জেলারের অধীনে একজন বিসিএস চিকিৎসককে কাজ করতে হয়। কারাগারে দায়িত্ব পালন করলে তাঁরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। তাই চিকিৎসকেরা সেখানে যেতে চান না। তা ছাড়া কোনো বন্দী অসুস্থ হলে তিনি হাসপাতালে থাকবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত দেন কারাগারের ‘নন–মেডিকেল ব্যক্তি’। এটি কেউ মেনে নিতে চান না।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ বছর ধরে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে তিনি একা। প্রতিদিন সকালে নানা রোগ নিয়ে ৩০০-৪০০ বন্দী আসেন। এর মধ্যে ডায়ালাইসিস, টিবি, এইডসের রোগীও রয়েছেন। এখানে কোনো ল্যাব নেই, যন্ত্রপাতি নেই। ফলে কাউকে যথাযথ চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায় না।

মাহমুদুল হাসান বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৭২ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক নেই, ওয়ার্ডবয় নেই, রেডিওলজিস্ট নেই, টেকনোলজিস্ট নেই। তাহলে এই হাসপাতাল কীভাবে চলবে। হাসপাতালে ভর্তির মতো ৪০০-এর বেশি বন্দী আছে। কিন্তু তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসার বেশি কিছু দেওয়া যাচ্ছে না।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক শামীম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে কারাগারে বন্দীর ধারণক্ষমতা প্রায় আড়াই হাজার। বন্দী আছেন তিন গুণ বেশি। এখানে দুজন অনুমোদিত চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কেউ ছিলেন না। আমাকে ঢাকা থেকে এখানে বদলি করা হয়েছে। প্রতিদিন আমাকে বহির্বিভাগে ২৫০ রোগী দেখতে হয়, আবার স্টাফদেরও দেখতে হয়। হাসপাতালে ইসিজি মেশিন ছাড়া আর কিছুই নেই। রুটিন চেকআপ করার জন্য যন্ত্রপাতি নেই।’

চিকিৎসকেরা কেন কারা হাসপাতালে থাকতে চান না—এমন প্রশ্নে শামীম রেজা বলেন, ‘এটি তো প্রমোশনাল পদ নয়। এখানে চাকরি করলে আমার পদোন্নতি হচ্ছে না, প্রশিক্ষণ নিতে পারছি না, প্র্যাকটিস করতে পারছি না।’

একই রকম কথা বলেন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক সারোয়ার রেজা। তিনি বলেন, ‘আমরা যাঁরা বিসিএস স্বাস্থ্যে চাকরি করি, তাঁদের স্বপ্ন থাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা সার্জন হওয়ার। কারাগারে কোনো ক্যাডার কর্মকর্তা থাকেন না, ফলে ইগো সমস্যা হয়। চিকিৎসকেরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। এ কারণে কারাগারে কেউ চাকরি করতে চান না।’

সারোয়ার বলেন, কুমিল্লা কারাগারে প্রায় ২ হাজার ৫০০ বন্দীর জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক। খুবই খারাপ অবস্থা। এভাবে রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কারাগার এবং চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা কারাগার ছাড়া সারা দেশের কারাগারে কোনো চিকিৎসক নেই। সংযুক্ত চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, নার্স দিয়েই এসব কারাগারে বন্দীদের কোনোমতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

কারাগারে মৃত্যু-আত্মহত্যা

বিশেজ্ঞরা বলছেন, যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অনেক কয়েদির মৃত্যু হয়। ঘটছে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও। ২০১৯ সালে পঞ্চগড়ে কারা হেফাজতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের মৃত্যু হয়। বিচারিক তদন্তে আত্মহত্যা বলা হলেও তাঁর পরিবার তা মানেনি। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদ মারা যান। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, হৃদ্রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

চলতি বছরের জুনে গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক কয়েদি গোলাম মোস্তফার মৃত্যু হয়। শৌচাগারের ভেতরে ভেন্টিলেটরের রডের সঙ্গে পায়জামার ফিতা পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে তদন্তে বলা হয়েছে।

গত ৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এ আফাজ উদ্দিন (২০) নামের এক হাজতির মৃত্যু হয়। তিনি আগের দিন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে না পেরে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

কারা কর্তৃপক্ষ এসব মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দাবি করছে। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, পরিবার এবং এমনকি সাধারণ মানুষ মনে করেন, চিকিৎসা না পেয়ে বা কারা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব বন্দী মারা গেছেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যে দেশে গরিব মানুষের অধিকার নেই, সেখানে রাষ্ট্র কারাবন্দীদের পেছনে টাকা খরচ করবে, তা চিন্তাও করা যায় না।

মিজানুর রহমান বলেন, কারাবন্দীদের মানবাধিকারের দিকে কারও লক্ষ্য নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা রয়েছে। খাবার, চিকিৎসা, আবাসন—সবক্ষেত্রেই পদে পদে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তাঁরা।