সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ ডাক নিয়ে মাঝেমধ্যেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ ‘স্যার না বলায়’ রংপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ক্ষুব্ধ আচরণ করেছেন, এমন অভিযোগ তুলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক অবস্থান কর্মসূচি শুরু করার ঘটনা নিয়ে এখনো ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিশেষ করে ফেসবুকেই এ আলোচনা বেশি হচ্ছে। রংপুরের ডিসি চিত্রলেখা নাজনীন সেদিন দুঃখ প্রকাশ করে ওই ঘটনার ইতি টানলেও আলোচনা থামছে না।
এ নিয়ে কথা হয় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদারের সঙ্গে। তাঁরা দুজনেই সম্বোধনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি না করে পারস্পরিক সম্মান ও বিনয়ী হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যার’ ডাক নিয়ে রংপুরের ডিসি যেটি করেছেন, সেটি বাড়াবাড়ি করেছেন বলে তাঁর কাছে মনে হচ্ছে।
এটি না করলেও পারতেন। কারণ, এ বিষয়ে সরকারি বাধ্যবাধকতা নেই। সুতরাং কে কী বলল বা না বলল, সেটি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করলেই পারতেন। এতে আসলে কারও মান বাড়ে না বা কমে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যেটি করলেন...এখানে সম্বোধন কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ের। তাই খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলে ভাই, আপা, দুলাভাই—এভাবে ডাকা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে পদ অনুযায়ী ডাকা যেতে পারে। যেমন সচিব সাহেব, ডিসি সাহেব, ইউএনও সাহেব—এমন করে ডাকলেও হয়। চেনা নেই, জানা নেই সেখানে হঠাৎই ভাই-আপা ডাকা ঠিক নয়। প্রয়োজনে নাম ধরেও ডাকা যেতে পারে।
এই ‘স্যার’ ডাক নিয়ে যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সমস্যা না হয়, সে ক্ষেত্রে পরামর্শ জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, আসলে কাউকেই এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। যিনি ডিসিকে স্যার ডাকা নিয়ে অসুবিধা মনে করছেন, তিনি হয়তো আরেক জায়গায় স্যার ডাকছেন। আবার ডিসি-ইউএনওদের এসব নিয়ে আপত্তি করা উচিত নয়। কারণ, সম্মান জোর করে আদায় করা যায় না। সম্মানের লোক মনে হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আসবে। আবার যাঁরা বিষয়টিকে উসকে দিচ্ছেন, তাঁরাও ঠিক করছেন না। পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকাটা জরুরি।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টরেরও দায়িত্ব পালন করেছেন, যেখানে সিভিল সার্ভিসের নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের বনিয়াদি প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁর মতে, সবারই উচিত পরস্পরের সঙ্গে শালীন ও শোভন আচরণ করা।
আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কেউ যদি কোনো অফিসে গিয়ে স্যার না ডাকে, তাহলে এটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। যিনি কাজে গেছেন, তাঁর কাজটি যদি ন্যায্য হয়, তাহলে সেটি করে দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে দ্রুত বিদায় করাই ভালো। আর যদি ন্যায্য না হয়, তাহলে অপারগতা প্রকাশ করে বিদায় দেওয়া উচিত। আবার যিনি কাজে গেলেন, তিনিও যদি সম্বোধন করতে না চান, তাহলে বিনয়ের সঙ্গে কাজটি করে চলে আসতে পারেন।
আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘আমরা কেন যেন অধৈর্য হয়ে পড়েছি। শুধু অন্যকে দোষ দিচ্ছি, নিজের ত্রুটির দিকে নজরই দিচ্ছি না। আর পদের ও বেতনের বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে তুলনাযোগ্য নয়। জেলা প্রশাসক তাঁর কর্মস্থলে সরকারের প্রতিনিধি। তিনি সরকার ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী। তাই তাঁকে বেতন দিয়ে মাপা অথবা স্যার ডাকার বাধ্যবাধকতা কোনোটাই যুক্তিসংগত নয়।’
সাবেক সচিব আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘সবারই উচিত পরস্পরের সঙ্গে শালীন ও শোভন আচরণ করা। কিন্তু আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই অন্যকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয় না। এটি কোনো ক্যাডারের বিষয় নয়। এটি এখন সামাজিক ব্যাধি।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্যার’ ডাকের সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হলে ওপর থেকে শুরু করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।