বিপিসির বিদেশি ঋণে ‘চড়া’ সুদ

বিপিসি ১০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ নিতে চায়। আপত্তি জানিয়েছে ইআরডি।

  • ব্যাংকে ডলার-সংকটের কারণে ঋণপত্র খোলা নিয়ে বিপাকে বিপিসি।

  • ছয় মাস আগে সুদের হার ছিল ৩.৫%, এখন ৫.৫%।

জ্বালানি তেলছবি: সংগৃহীত

ডলার-সংকটে জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খুলতে জটিলতায় ভুগছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তাই ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিদেশি ঋণ নিতে চায় তারা।

যদিও এই ঋণ নেওয়ার উদ্যোগে আপত্তি জানিয়েছে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তারা বলছে, বিপিসি ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) নামে যে সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেবে, তাদের সুদের হার বেড়ে গেছে। ছয় মাস আগে যেখানে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যেত, সেটা এখন পড়বে সাড়ে ৫ শতাংশের মতো।

বিষয়টি এখন গড়িয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ইআরডি এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে। ইআরডির সচিব শরিফা খান প্রথম আলোকে বলেন, বিপিসিকে এরই মধ্যে ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে এখন চড়া সুদে এই ঋণ না নেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে ইআরডি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হয়েছে।

এখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা জরুরি। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে সরকার যে ঋণ চেয়েছে, তা যদি শিগগিরই না পাওয়া যায়, তাহলে বিকল্প উৎস ভাবা যেতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক

তেল আমদানিতে জটিলতা

দেশে জ্বালানি তেল আমদানি করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি। বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত ও ৪০ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে মাসে গড়ে তাদের ১৫ থেকে ১৬টি ঋণপত্র খুলতে হয়। দেশে যে ডলার-সংকট চলছে, তাতে কয়েক মাস ধরেই ঋণপত্র খোলা নিয়ে বিপিসি জটিলতায় পড়েছে।

বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিময় হার ধরে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ঋণপত্র খুলতে রাজি হচ্ছে না। তাদের দিয়ে ঋণপত্র খোলাতে নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তদবির করতে হয়। এমনকি বেসরকারি ব্যাংকে বাড়তি দামে ডলার কিনেও কিছু ঋণপত্র খুলতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে জ্বালানি তেলের সরবরাহ ধরে রাখা কঠিন।

সরকারি করপোরেশনগুলো বিদেশি ঋণ চাইলে আগে ইআরডির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারাই ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়। এ দফায় আইটিএফসির কাছ থেকে ঋণ নিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিপিসি ইআরডিকে চিঠি দেয় গত ১৮ আগস্ট।

আইটিএফসি ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) একটি সহযোগী সংস্থা। সদস্যদেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও মালিকানা আছে এ ব্যাংকে। ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ সুদে বিপিসিকে ঋণ দেয় তারা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সফর), যা এখন প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ।

ইআরডি বলছে, ছয় মাসে আগে আইটিএফসির ঋণের সুদের হার ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ। এখন সুদের হার সাড়ে ৫ শতাংশ। তাই এখন সংস্থাটি থেকে ঋণ নেওয়া সমীচীন হবে না। উল্লেখ্য, এর আগে জরুরি প্রয়োজনে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছিল অর্থ বিভাগ।

বিপিসির ঋণ চাহিদার বিষয়ে জরুরি মতামত জানতে চেয়ে গত ২৪ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় ইআরডি। এতে উল্লেখ করা হয়, বিদেশি ঋণ না বাড়িয়ে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণপত্র খুলে তেল আমদানি করতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে পরামর্শ দিয়েছিল অর্থ বিভাগ।

ইআরডির চিঠির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, এখন বাড়তি ঋণ বিপিসির জন্য কতটা জরুরি; তা জ্বালানি বিভাগের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।

এদিকে আগের শর্তে, অর্থাৎ কম সুদে বিপিসির জন্য বাড়তি ১০০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে আইটিএফসিকেও চিঠি দিয়েছিল ইআরডি। জবাবে সংস্থাটি জানিয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশ তাদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার আবেদন করেছে। সেসব আবেদন বিবেচনা করতে হচ্ছে তাদের। বাংলাদেশের বাড়তি ঋণ আবেদনটি পর্যালোচনা করছে। পরে জানানো হবে।

বিপিসি যা বলছে

বিপিসির তিনজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আইটিএফসি থেকে নেওয়া ঋণ দীর্ঘমেয়াদি নয়। বিপিসি এখান থেকে নিয়মিত ঋণ নেয়। কিস্তি হিসেবে প্রতিটি ঋণপত্রের বিল পরিশোধে টাকা ছাড় করে আইটিএফসি। ঋণপত্র খোলার ঠিক ছয় মাস পর ঋণের টাকা পরিশোধ করে বিপিসি। এভাবেই ধাপে ধাপে ছয় মাস মেয়াদে প্রতিটি ঋণপত্রের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ করা হয়। এবার এক বছরের মেয়াদে ঋণ চাওয়া হয়েছে।

বিপিসির কর্মকর্তারা আরও বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইটিএফসির সুদের হার (সফর) নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। ঋণের টাকা পরিশোধের সময় বিদ্যমান সফরের হার ধরেই তা শোধ করতে হয়। তাই আগের ঋণের ক্ষেত্রেও নতুন সুদের হার কাজ করছে। তাই এ ঋণে ইআরডির আপত্তির বিষয়টি তাদের বোধগম্য নয়।

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত ঋণপত্র খোলা সম্ভব হচ্ছে না। তাই জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খোলার বিষয়টি স্বাভাবিক রাখতেই নতুন করে ঋণ চাওয়া হয়েছে। এখন সরকার যা সিদ্ধান্ত দেবে, তা মেনেই বিপিসি কাজ করবে।

ডিজেল কিনতেই লাগছে ঋণ

বিপিসি সূত্র বলছে, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। তুলনামূলক কম খরচে ডিজেল কিনতে নতুন উৎস খুঁজছে সরকার। রাশিয়া, ব্রুনেই ও ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এ প্রক্রিয়ায় তেল পেতে আরও সময় লাগতে পারে। এখন বাড়তি দামে তেল কিনতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। তাই মূলত ডিজেল কিনতেই নতুন করে ঋণ চাওয়া হয়েছে।

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা জরুরি। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে সরকার যে ঋণ চেয়েছে, তা যদি শিগগিরই না পাওয়া যায়, তাহলে বিকল্প উৎস ভাবা যেতে পারে।

তিনি বলেন, আইটিএফসি থেকে বিপিসি যে ঋণ চেয়েছে, তা কিছুটা বেশি সুদের হলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে স্বল্পমেয়াদি হলে এই ঋণ চাপে ফেলবে। বরং মেয়াদ কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া যায় কি না, সেটা দেখা যেতে পারে।

জ্বালানি তেলের একটা বড় অংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায় জানিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, মধ্য মেয়াদে জ্বালানির জন্য বিদেশনির্ভরতা কমাতে দেশে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিতে হবে।