বিএনপিকে ভোটের বাইরে রাখতে বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে

ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ ‘সাজানো নির্বাচন, বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আয়োজন করে
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যে সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক—কোনোটাই হবে না, তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে ডামি (বিকল্প) প্রার্থী দাঁড় করিয়ে নির্বাচন করতে যাচ্ছে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে রাজনীতি ও নির্বাচনী মাঠ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর এসব করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিচারব্যবস্থাকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশে আগামী এক বছরে অস্থিরতা তৈরি হবে।

আজ শুক্রবার এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের উদ্যোগে ‘সাজানো নির্বাচন, বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন’ শীর্ষক এ ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।

ওয়েবিনারে নির্বাচন প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘২০১৪ সালে একভাবে চুরি হয়েছে। ২০১৮ সালে হয় আরেকভাবে। এবার ২০২৪ সালে অন্য ধরনের চুরি হবে। চুরি ঠিকই হবে। অর্থাৎ নির্বাচন চুরি হবে।’

সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে যাচ্ছে, তাতে দেশে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা করেছেন শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ৭ জানুয়ারি পর থেকে ২০২৫ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে কী অবস্থা হবে, তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত। নিরাপত্তা, স্বস্তিতে থাকা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবন, অন্যায় হলে প্রতিকার পাওয়া—সবই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কিছু লোক অস্থির হয়ে বিপথে চলে যেতে পারে। এই ৭ জানুয়ারি নির্বাচন যেভাবে হতে যাচ্ছে, সেভাবে হলে পরের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশটা বসবাসের অযোগ্য হবে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য এখন যে অবস্থা আছে তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা হবে। তবে তিনি আশা করেন তাঁর এই আশঙ্কা যেন ঠিক না হয়।

যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হচ্ছেন, তাঁরা একই মামলায় জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। তাহলে এই জামিন কি আদালত না সরকারের ইচ্ছায় হয়?
আসিফ নজরুল, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শাহদীন মালিক বলেন, দেশে সাধারণত প্রতি ১০০ মামলার ২৫টিতে দোষী সাব্যস্ত হয়। বাকিগুলো খালাস হয়ে যায়। এখন বিএনপির বিরুদ্ধে মামলায় ৯০ শতাংশের বেশি আসামি দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন। ন্যায়বিচার শুধু করলেই হবে না, জনগণের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। বিএনপির নেতা–কর্মীদের যেসব মামলা হচ্ছে, তার প্রভাব অন্য মামলাতেও পড়বে। বিচার বিভাগে আস্থাহীনতা বেড়ে যাচ্ছে এসব মামলার কারণে। সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল, বিএনপিকে মাঠের বাইরে বের করে দিচ্ছে। এর যে খেসারত দিতে হবে। কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় যদি বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হ্রাস পায় সেই সমাজে অনেক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইন খুব কড়া। যাঁরা সরকার পক্ষের লোক, তাঁদের প্রতি আইন প্রয়োগ হয় না। আইনের শাসন এখন পক্ষপাতমূলক হয়ে গেছে। বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সরকার যে সাজানো নির্বাচন করতে চাইছে তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে, নিশ্চয়তা না পেলে অনেকে প্রার্থী হতে চাইছেন না। সাজানো নির্বাচন করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে রাজনীতি ও নির্বাচনী মাঠ থেকে জেলে পাঠিয়ে ও গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে। নির্বাচনের আগে মামলা–হামলার ভয় দেখিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের অংশগ্রহণ দূরের কথা স্বাভাবিক চলাফেরার স্বাধীনতা ভোগ করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, ৭ জানুয়ারি যেটা হতে যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ডামি (বিকল্প) প্রার্থীর অনুগত দলগুলোর নির্বাচন। এটা সিলেকশন (বাছাই) প্রক্রিয়ার মতো।

কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় যদি বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হ্রাস পায় সেই সমাজে অনেক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

আসিফ নজরুল বলেন, বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ ছাড়া করার প্রক্রিয়ায় শুধু পুলিশ বাহিনী বা দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করা হচ্ছে না। এখানে আদালতব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। কারণ, আদালত মানুষের শেষ ভরসার আশ্রয়স্থল। আদালতকে যখন নিপীড়ন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন একটি দেশে আইনের শাসন আর ভরসা করার মতো কোনো জায়গা থাকে না।

আইনের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হচ্ছেন, তাঁরা একই মামলায় জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। তাহলে এই জামিন কি আদালত না সরকারের ইচ্ছায় হয়?’ তিনি আরও বলেন, বিরোধী দলকে মাঠ ছাড়া করতে সরকার ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে। বিচারব্যবস্থা থেকে দায়মুক্ত রেখেছে নিজ দলের সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের, আইনের শাসনের ব্যত্যয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ ঘটলে কোনো বিচারিক প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।

মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি মনজিল মোরসেদ বলেন, যে যাঁর অবস্থানে স্বাধীনভাবে কথা বলতে, মতামত দিতে পারেন না। বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীরা লোভ–লালসায় পড়ে গেছেন। সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য প্রয়োজনে ডাহা মিথ্যা কথাও বলছে টিভিতে। গণমাধ্যমও আগের মতো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, বিচারকরা স্বাধীনভাবে রায় দিতে চান, পুলিশও চায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক। কিন্তু সে পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।

আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক কোনোটাই হবে না, তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে সে দেশের গণতন্ত্র আছে, তা বলা যাবে না। এ পরিস্থিতি চললে আইনের শাসন অনুপস্থিত থাকে। বিচার বিভাগের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকার অভাব দেখা যায়।

ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন কলামিস্ট জাহেদ উর রহমান। সূচনা বক্তব্য দেন মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান।