ঋণ করে, গবাদিপশু বেচে টিকে থাকার চেষ্টা

  • ৮২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছেন না।

  • ৮ মাসে টিসিবি থেকে খাদ্য কেনা মানুষের হার বেড়ে ২০ শতাংশ।

বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে গবাদি পশু চরাতে নিয়ে যাচ্ছেন রাখালেরা। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা এলাকায় যমুনার চরে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রামের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন মরিয়ম বেগম (৭২) ও তাঁর মেয়ে বনো বেগম (৫২)। দুজনেরই পেশা কৃষিশ্রমিক। কাজ পেলে দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পান। না পেলে বয়স্ক ভাতা হিসেবে মাসে পাওয়া ৫০০ টাকাই তাঁদের একমাত্র ভরসা। কয়েক মাস ধরে কাজ নেই। ফলে তিন বেলার জায়গায় মা–মেয়ে দুই বেলা খেয়ে থাকছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের কর্মীরা জরিপের কাজে মরিয়মের কাছে যান। তিনি তাঁদের বলেন, আজকে খাওয়ার একটি রুটি আর একটি কলা ছাড়া তাঁদের কাছে আর কিছু নেই। এক বেলা খেতে পারলে পরের বেলা কী খাবেন, তা বলতে পারেন না। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।

শুধু মরিয়ম আর তাঁর মেয়ের এই অবস্থা নয়। দেশের গ্রামীণ জনপদের বেশির ভাগ দরিদ্র মানুষের অবস্থা এই রকম। গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি সংস্থা কেয়ার দরিদ্র মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব কতটুকু, তা নিয়ে একটি জরিপ চালায়।

গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে খরচ কমানো মানুষের হার চার গুণের বেশি বেড়েছে।
খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির যে বহুমাত্রিক প্রভাব তৈরি হয়েছে, তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের পুষ্টিহীনতা থেকে শুরু করে শিক্ষা–স্বাস্থ্য খাতে অবনতি হবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করবে।
হোসেন জিল্লুর রহমান, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ

দেশের উত্তর ও হাওরাঞ্চলের ৮টি জেলায় চালানো জরিপে দেখা যায়, ৮২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছেন না। গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে এই মানুষের হার ২ শতাংশ বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৭২ শতাংশ হয়েছে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির যে বহুমাত্রিক প্রভাব তৈরি হয়েছে, তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের পুষ্টিহীনতা থেকে শুরু করে শিক্ষা–স্বাস্থ্য খাতে অবনতি হবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করবে।

সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত চাল রয়েছে উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর বলেন, সরকারের উচিত দরিদ্র মানুষের জন্য চালের পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা। আর স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য সেবায় নগদ সহায়তা বাড়ানো।

জরিপে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত নিয়ে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এসেছে। গত বছরের জুনে যেখানে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পারছিলেন না, এই ফেব্রুয়ারিতে সেই হার চার গুণ বেড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ হয়েছে।

দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাবার দিচ্ছে সরকার। রমজান উপলক্ষে বিনা মূল্যে চালসহ অন্যান্য কর্মসূচির আওতায় এক কোটি মানুষকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। বাজারে খাদ্যের দাম বাড়লেও দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট নেই।
সাধন চন্দ্র মজুমদার, খাদ্যমন্ত্রী

ওই সময় পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারেননি প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে প্রায় ৫৩ শতাংশ হয়েছে। ওই সময়ে শিক্ষা খরচ জোগাতে পারছিলেন না ১১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ, যা ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে হয়েছে ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ।

পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে দরিদ্র মানুষ আট ধরনের নেতিবাচক উপায় বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে খাবারের মান কমানো। গত জুনে খাবার কেনার পরিমাণ কমিয়েছিলেন প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ। এই ফেব্রুয়ারিতে তা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে প্রায় ৭৭ শতাংশ হয়েছে। বাকিতে খাবার কেনেন, এমন মানুষের হার ১৮ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়েছে। হঠাৎ অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না নেওয়া মানুষের হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাবার দিচ্ছে সরকার। রমজান উপলক্ষে বিনা মূল্যে চালসহ অন্যান্য কর্মসূচির আওতায় এক কোটি মানুষকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। বাজারে খাদ্যের দাম বাড়লেও দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট নেই।

জরিপে দেখা গেছে, আয় কমে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষ গবাদিপশু বিক্রি করছেন, এনজিওর কাছ থেকে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ এবং মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নেওয়ার পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

গবাদিপশু বিক্রি করা মানুষের হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ নেওয়ার হার ২ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। মানুষ আগে নিতান্তই বিপদে না পড়লে উচ্চ সুদের দাদন নিতেন না। গত বছরের জুনে এই হার ছিল দশমিক ৪ শতাংশ। আর এই ফেব্রুয়ারিতে সেই হার বেড়ে হয়েছে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ।

পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে মানুষ সরকারি সংস্থাগুলোর সেবা নেওয়া বাড়িয়েছে। দরিদ্র পরিবারগুলোকে বন্ধু, পাড়া–প্রতিবেশী আগের চেয়ে বেশি সহায়তা করছেন। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছ থেকে খাদ্য কেনা মানুষের হার দেড় শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে।