অন্তর্ভুক্তির ধারণা হোঁচট খেয়েছে, বিভক্তি ফিরছে নতুন রূপে
আওয়ামী লীগ তার শাসনামলে যখন থেকে ‘সর্প হইয়া দংশন করে ওঝা হইয়া ঝাড়া’র নীতি গ্রহণ করেছিল, তখন থেকেই দলটির সেক্যুলার, প্রগতিপন্থী হিতাকাঙ্ক্ষীরা মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলেন যে এই ভ্রান্ত নীতির কারণেই দূর অথবা অদূর ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর বাঁধভাঙা উত্থান ঘটবে। তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন, ইসলামপন্থার সেই বাঁধভাঙা উত্থান হবে অসহিষ্ণু, পাল্টা আধিপত্যকামী।
শেখ হাসিনা নেতা-কর্মীদের অন্ধকারে রেখে জনরোষ থেকে বাঁচতে প্রাণভয়ে এভাবে পালিয়ে যাবেন, সেটা দিব্যচোখে দেখা না গেলেও তাঁর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন যে একদিন ভেঙে পড়বে, তা অনেকেই ভেবেছিলেন এবং সেই মাঠ ইসলামপন্থীদের দখলে চলে যাবে, এ কথাও কল্পনাতীত কিছু ছিল না। মুশকিল হলো, এসব বুঝতে পেরেও আওয়ামী লীগের শুভার্থীরা, তার মিত্র বামপন্থী সংগঠনগুলো তাঁদের নেতা–নেত্রীদের ধর্মের কার্ড খেলার বিপজ্জনক রাজনীতি থেকে ফেরাতে পারেননি।
অন্যদিকে লীগের প্রতি বিশেষ কোনো পক্ষপাত নেই, তাদের চেতনা ব্যবসা সম্পর্কেও সম্যক সচেতন—এমন প্রগতিশীল মানুষজন কিংবা সংগঠনগুলোও আসন্ন ইসলামপন্থার সঙ্গে কীভাবে বোঝাপড়া করবেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছিলেন, এমন আভাস দেখা যায়নি। আমার মনে আছে, ২০২২ সালের ২৩ জুলাই অধ্যাপক আলী রীয়াজের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে আমি অনাগত ইসলামপন্থা প্রসঙ্গে
কথা বলেছিলাম; অনুষ্ঠান শেষে আমার এক বামপন্থী তরুণ বন্ধু ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন যে ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশে আসবেই—এ কথা আমি বলে দিলাম! উনি কেন কথাটা বলেছিলেন আমি ঠিক জানি না, কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা নিছকই অনুচ্চারিত আশঙ্কা কিংবা দূরবর্তী সম্ভাবনামাত্র ছিল এমন নয়।
আওয়ামী লীগ এক হাতে জঙ্গি দমনের নাটক করেছে, অন্য হাতে হাসিনার কওমি জননীর মুকুট রক্ষা করেছে। চব্বিশের জুলাইয়ের আগুনঝরা যেসব দেয়াললিখন আমাদের অনেকের চোখ খুলে দিয়েছিল, তার একটা ছিল, ‘সঙ্গে থাকলে সঙ্গী, না থাকলে জঙ্গি’! এই সরল উপলব্ধি বিগত রেজিমে যেনবা বিদ্বজ্জনেরা ধরতেই পারেননি। উল্টো, লীগের নেতৃত্ব এই প্রশ্ন আমাদের মগজে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে যে ‘বিকল্প কে?’ তারা এই আওয়াজ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে যে তারা না থাকলে জঙ্গিরা সব দখল করে নেবে।
এই জুজুর ভয়ের কারণেই সেক্যুলারদের একটা বড় অংশ ভয়াবহ দুর্নীতি, নিপীড়ন, দুঃশাসন দেখার পরও আওড়ে গেছেন, ‘বিকল্প কে?’ সমাজের সেক্যুলার ও প্রগতিপন্থীদের একটা বড় অংশ আওয়ামী শাসনের প্রতি হেলে থাকার বাস্তবতা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারবেন না, এ কথা সত্য। কিন্তু একইভাবে আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশে একটা নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। ইসলামপন্থার উত্থান প্রসঙ্গে সেক্যুলারদের মোটাদাগে যে আশঙ্কা ছিল, এখন সরব ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারাগুলোর কারও কারও ভাষা, ভঙ্গি, উপস্থিতি ও তৎপরতা, তাকেই বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সামনের দিনে বিবিধ ইসলামপন্থীরা নিজেদের দলীয়, গোষ্ঠীগত ও সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি কীভাবে দাঁড় করাবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে নানা কিসিমের ইসলামপন্থাকে সরব এবং সক্রিয় হতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক নানা ব্যানারে তাঁরা সক্রিয় হয়েছে। কেউ গণতন্ত্র ও নির্বাচন মানেন, কেউবা আন্তর্জাতিকতাবাদী, খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, ভাষা, ভঙ্গি বিচারে এঁদের কাউকে চরম ডানপন্থী, কাউকে উদারনৈতিক কিংবা মধ্যপন্থী মনে হতে পারে। নির্বাচনী রাজনীতিতে এঁরা কে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন, কার সঙ্গে কে জোট বাঁধবেন, সেসব এখনো স্পষ্ট হয়নি।
কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে তাঁদের সাংগঠনিক ভিন্নতাকে ছাপিয়ে যে সত্যটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, পরিচয়ের রাজনীতির পরিসরে তাঁরা ‘ইসলামি’ ক্যাটাগরি হিসেবে তাঁদের হিস্যা বলে–কয়ে আদায় করতে শুরু করেছেন। তাঁরা এ বিষয়ে দলমত-নির্বিশেষে একমত বলেই প্রতীয়মান হয় যে বিগত আমলে ইসলামপন্থাকে জনপরিসরে জায়গা দেওয়া হয়নি, ইসলামি পরিচয়ের স্মারক, দাড়ি, টুপি কিংবা হিজাব থাকলেই মানুষজনকে সমাজের, রাষ্ট্রের নানা পর্যায়ে বৈষম্য, দুর্ভোগ কিংবা নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল। কাজেই ইসলামপন্থীরা এসবের আশু অবসান চান—সাদাচোখে ব্যাপারটা এমনই।
এ কথা সত্য যে আওয়ামী লীগ ইসলামপন্থীদের মধ্য থেকে তাদের পছন্দসই অংশকে নিজের দলে ভিড়িয়েছিল এবং অপছন্দের অংশকে কোণঠাসা করেছিল। রাজনীতির মাঠে জামায়াতে ইসলামী যেন তাদের প্রতিপক্ষ না হয়ে উঠতে পারে, সে লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। তারা বিএনপিকে তৃণমূলে যেভাবে দমন-পীড়ন করেছিল, জামায়াতের ক্ষেত্রেও সেই কৌশল বেছে নিয়েছিল। তাই জামায়াতের ওপর আওয়ামী লীগের নিপীড়নকে ঠিক ইসলামের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হওয়া বলে দেখানো যাবে না।
কিন্তু সমস্যাটার গোড়া আরও অনেকটা গভীরে প্রোথিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে আইডেন্টিটি পলিটিকস বা পরিচয়ের রাজনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইসলামকে যেভাবে বাঙালিত্বের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে, তার মধ্য দিয়ে সেক্যুলার ও ইসলামের একটা গৎবাঁধা ধারণা বা স্টেরিওটাইপ তৈরি হয়েছে, যেখানে এ দুটি পরস্পরের সঙ্গে বেমানান। এই নির্মাণ এ দেশে সেক্যুলার ও ইসলামপন্থীদের মধ্যকার বিভক্তি পাকাপোক্ত করেছে।
পরের দশকগুলোতে আওয়ামী লীগ এই বিভক্তির রাজনীতিকেই লাগাতার পরিপুষ্ট করেছে। উভয় পক্ষই পরস্পরের ব্যাপারে চূড়ান্ত রকমের বিদ্বেষপ্রবণ ও অসহিষ্ণু। এই বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশে সেক্যুলাররা শ্রেণিগত দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন, সে তুলনায় প্রান্তিক ইসলামপন্থীরা নানা সামাজিক দুর্ভোগ ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ইসলামপন্থীরা এখন সেই হেনস্তার অবসান চান, তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি চান।
রাষ্ট্রে সব নাগরিকের সমান হিস্যা থাকা আবশ্যক। কিন্তু কেবল সেক্যুলারপন্থা বিক্রি করা চেতনা ব্যবসায়ীরা বিদায় নিলেই কি নাগরিকদের সমান হিস্যা প্রতিষ্ঠিত হবে? এটা কি কেবল রেজিম বা শাসক বিশেষের সমস্যা নাকি নিপীড়নের, আধিপত্যের মন ও মগজ বদলানোর এর সঙ্গে বিষয়টা জড়িত? ৫ আগস্টের পর আমরা নতুন বন্দোবস্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কথা বলেছি। তার প্রথম ধাপের কাজ ছিল পরিচয়ের রাজনীতিতে উপেক্ষিত প্রপঞ্চ ‘ইসলাম’কে জায়গা দেওয়া। আমরা বাংলা বর্ষবরণে অনেক বছর ধরে চলে আসা মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, তাতে সুলতানি আমলের স্মারক, প্রতীক যুক্ত করেছি।
আমরা বিগত আমলে শ্রেণিকক্ষে ধর্মীয় স্মারকের কারণে নিগৃহীত হওয়ার গল্প শুনেছি, তার প্রতিকার চেয়েছি। আমরা ধরে নিচ্ছি, এটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ। কিন্তু এই অন্তর্ভুক্তির ধারণা হোঁচট খায়, যখন আমরা দেখি মফস্সলে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাজার ভাঙা হচ্ছে, খাদেমকে মারধর করা হচ্ছে, বিচারগানে বাধা দেওয়া হচ্ছে, বিবিধ সাংস্কৃতিক চর্চাকে ধর্মের নামে বাধা দেওয়া হচ্ছে, জটাধারী ফকির/পাগলকে ধরে–বেঁধে চুল কেটে গোসল করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, সংস্কৃতি, ধর্ম, ধর্মানুভূতির এই নতুন দ্বাররক্ষক কারা, যাঁরা প্রকারান্তরে সমাজে আবারও বর্জনমূলক চর্চার বিস্তার ঘটাচ্ছেন? বিশ্বাসীরা মনে করেন ধর্মের রক্ষক স্বয়ং আল্লাহ। তাহলে কোন বান্দা নিজেকে ধর্মরক্ষী বানিয়ে তুলছে?
এই সমাজের বড় রোগ বিভক্তির রাজনীতি। অগ্নিঝরা জুলাইয়ে অনেক রক্ত দিয়ে এ দেশের মানুষ আশা করেছিল যে সেই রাজনীতির অবসান ঘটবে। কিন্তু জুলাইয়ের পরে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিভক্তির রাজনীতিকে সফল করার জন্য আমরা উঠেপড়ে লেগেছি। আগে রাজনীতি ও সংস্কৃতির দ্বাররক্ষক ছিল রেজিমের তল্পিবাহকেরা। তখন যাঁরা বেইনসাফির শিকার হয়েছিলেন, নিপীড়িত হয়েছিলেন, এখন কি তাঁরা দ্বাররক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন? ধর্ম ও সমাজ রক্ষার নামে অন্যকে নিপীড়ন করবেন? অন্যের প্রাপ্য ইনসাফ কেড়ে নেবেন? নাকি যে আপনাকে ইনসাফ থেকে বঞ্চিত করেছে, আপনি তার জন্য ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন?
বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি ইসলামকে সরিয়ে রেখেছিল বলে কি ইসলামপন্থী রাজনীতি এখন বাঙালিত্ব মুছে ফেলতে চাইবে? এমনটা কি করা যায়, না এর ফল আখেরে ভালো হয়? এত রক্তক্ষয়ের পরে আমাদের প্রয়োজন ন্যায্যতা, ইসনাফ প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিশোধ-প্রতিহিংসাপরায়ণতা আর যা–ই পারুক, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। যাঁরা শাসকের আসনে বসবেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, তাঁরা দল বা গোষ্ঠীর নন, সব নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধ। এই দেশ ও সমাজকে সবার জন্য সমান বাসযোগ্য করে গড়ে তোলাই হতে হবে তাঁদের প্রধানতম অঙ্গীকার।
সাঈদ ফেরদৌস
সহ-উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়