আজ ২৬ এপ্রিল বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। ২০০০ সাল থেকে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউভিএ) উদ্যোগে প্রতিবছর এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার দিবসটি পালিত হয়। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য প্রাণীর স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ভেটেরিনারিয়ান, টেকনিশিয়ান, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদান।
বাংলাদেশেও সাধারণত সেমিনার, প্রাণীর স্বাস্থ্য ক্যাম্প, টিকাদান কর্মসূচি ও প্রাণীচিকিৎসকদের সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে এই দিবস পালিত হয়। স্থানীয় প্রাণীচিকিৎসা সংস্থা, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্রাণীর স্বাস্থ্যরক্ষায় দলগত প্রচেষ্টা’। এর মূল বার্তা হলো, প্রাণীদের একটি কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য কেবল ভেটেরিনারিয়ান বা প্রাণীচিকিৎসকদের নয়; বরং টেকনিশিয়ান, নার্স, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিত অবদান অপরিহার্য। বর্তমান বৈশ্বিক ও স্থানীয় পটভূমিতে প্রাণীর স্বাস্থ্য কেবল প্রাণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, জনস্বাস্থ্য, নিরাপদ খাদ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সারা বিশ্বে মানুষের মধ্যে যেসব সংক্রামক রোগ এখন দেখা যাচ্ছে, তার ৬০ শতাংশ এসেছে বিভিন্ন প্রাণী বা পশুপাখি থেকে। এর জন্যই প্রয়োজন দলগত প্রচেষ্টা, যেখানে গবেষকেরা নতুন রোগ ও প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করবেন, টেকনিশিয়ানরা মাঠপর্যায়ে সেবা দেবেন এবং প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকেরা কার্যকর অবকাঠামো ও সংস্থান নিশ্চিত করবেন।
বাংলাদেশে প্রাণীস্বাস্থ্য: চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা
বিশ্বব্যাপী ভেটেরিনারি চিকিৎসা ও প্রযুক্তির অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনো প্রাণীর স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। রোগবালাইয়ের কারণে দেশে প্রতিবছর প্রাণিজ উৎপাদনে গড়ে ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ ক্ষতি হয়। অথচ দেশে প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে সরাসরি জড়িত প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ এবং পরোক্ষভাবে ৬১ শতাংশ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা ও একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা।
গ্রামাঞ্চলে এখনো ভেটেরিনারি চিকিৎসা ও প্রাণীদের ভালো মানের ওষুধ সহজলভ্য নয়। ফলে ‘হাতুড়ে চিকিৎসক’দের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেক সময় ভুল চিকিৎসা ও আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার দমদমা গ্রামে মাত্র দুই সপ্তাহে লাম্পি স্কিন ও খুরারোগে আক্রান্ত হয়ে ২১টি গরু মারা যায়।
পোলট্রি খাতেও রয়েছে বেশ কিছু সমস্যা। বারবার বার্ড ফ্লুর প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে জানান, ২০০৭–০৮ সালে ৪৭টি জেলার ১২৮টি উপজেলায় বার্ড ফ্লু দেখা দিয়েছিল। তখন প্রায় ১৬ লাখ মুরগি ও ২২ লাখ ডিম ধ্বংস করতে হয়, যার ফলে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বেকার হন এবং আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। এই সমস্যা থেকে এখনো পুরোপুরিভাবে মুক্তি সম্ভব হয়নি। পানিদূষণের কারণে মাছ ও জলজ প্রাণীর মৃত্যু নিয়মিত দেখা যাচ্ছে।
এ ছাড়া দেশে মানসম্পন্ন ও সুষম প্রাণীখাদ্যের সংকট তো আছেই। বাজারে নিম্নমানের বা ভেজাল ফিডের কারণে অনেক প্রাণী পুষ্টিহীনতার রোগে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে ফিডের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষকদের পক্ষে মানসম্মত ফিড কেনা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রাণীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং চিকিৎসার ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতের জন্য বছরে ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন ফিডের চাহিদা রয়েছে, যার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ দেশীয় উৎপাদনে পূরণ হচ্ছে। ফিডের কাঁচামাল, যেমন সয়াবিন মিল, ভিটামিন প্রিমিক্স ও ফিশ মিলের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এখনো আমদানি করতে হয়। তবে স্থানীয়ভাবে কৃষিভিত্তিক কাঁচামাল (যেমন সয়াবিন চাষ, মিনারেলসমৃদ্ধ ফসল) উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে আকিজ অ্যাগ্রো ফিড লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ টি এম হাবিব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময় বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো আমাদের খামারিরা। তাঁদের হাতে যদি সঠিক পুষ্টিমানের ফিড সঠিক সময়ে ও সুলভ মূল্যে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে উৎপাদনে অভাবনীয় পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ বিশ্বাস থেকেই আমরা বিশ্বমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, যেমন জার্মান প্রযুক্তিনির্ভর মেশিনারিজ এবং কাঁচামাল সংগ্রহ করছি দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নির্ভরযোগ্য উৎস থেকেও।’
এ টি এম হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘শুধু উৎপাদন করলেই তো হয় না, আমরা চেষ্টা করছি যেন ফিড সঠিকভাবে ও সময়মতো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে যায়। এ জন্য আমরা গড়ে তুলেছি একটি দক্ষ ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক। এর পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব টেকনিক্যাল সার্ভিস টিম মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সহায়তা করে চলেছে, যাতে তাঁরা শুধু ফিডই নয়; বরং পুষ্টির ব্যবস্থাপনা, সঠিক ব্যবহারবিধি ও উৎপাদন–পরবর্তী টেকনিক্যাল জ্ঞানও গ্রহণ করতে পারেন।’
এ টি এম হাবিব উল্লাহ আরও বলেন, ‘বর্তমানে আকিজ ফিড থেকে আমরা ভেটেরিনারি মেডিসিন খাতে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য হলো, খামারিদের যেন ফিড ও স্বাস্থ্যসেবা এক জায়গায় একত্রে দেওয়া যায়। একটি ফার্ম সফল করতে শুধু পুষ্টি নয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার দিকেও নজর দিতে হয়। সেই সঙ্গে আমরা একটি রিসার্চ ও ফিল্ড সাপোর্টভিত্তিক মডেল তৈরি করছি, যেখানে খামারিরা পরামর্শ, ট্রেনিং ও সেবা একসঙ্গে পাবেন। সর্বোপরি একটি স্বাস্থ্যবান, উৎপাদনশীল ও টেকসই কৃষি ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় কী?
বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস–২০২৫–এর প্রতিপাদ্য অনুসরণ করে বাংলাদেশে প্রাণীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করতে দলগত প্রচেষ্টা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ জন্য প্রয়োজন কৃষকদের মধ্যে রোগবালাই ও প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা, মাঠপর্যায়ে দক্ষ ভেটেরিনারি টেকনিশিয়ান ও সেবার প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করা, বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলগুলোয় স্থানীয় রোগ নিয়ে গবেষণা ও আধুনিক ভেটেরিনারি হাসপাতাল স্থাপন এবং প্রাণী স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ ও কার্যকর নীতি প্রণয়ন।