বিচার হয় না বলে বেপরোয়া ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুবর্ণা মজুমদার

দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল ঘিরে ‘নির্যাতনকেন্দ্র’ গড়ে উঠেছে। এসব নির্যাতনের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নাম জড়িয়ে পড়ছে। আর এসব ঘটনা ঘটছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। কিন্তু সব ঘটনার বিচার হয় না। কিছু ঘটনায় লোকদেখানো কর্মকাণ্ড হয়, পরে সবাই সব ভুলে যায়। বিচার হয় না বলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নির্যাতনের এসব ঘটনায় এখন নতুন সংযোজন হলো বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করা। এটি নির্যাতনকে একটা নতুন রূপ দিচ্ছে। সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন ফুলপরী খাতুন নামের এক শিক্ষার্থী। প্রথম আলোয় এ সংবাদ পড়ে রীতিমতো চমকে ওঠার উপক্রম হয়েছে। ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা ওই ছাত্রীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল ও এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। প্রযুক্তি এখন নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তবে ফুলপরী দমে যাননি। তাঁর সাহস আমাদের জন্য অনুকরণীয়। আমাদের সবার উচিত ফুলপরীর পাশে দাঁড়ানো।

এ ঘটনা শুধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে, এমনটা নয়, গত বছরের ১৭ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেও চার ছাত্রকে নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও আমরা দেখেছি একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। একটি ঘটনা যখন ঘটে, তখন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরপর মাসের পর মাস চলে গেলেও বিচার পান না ভুক্তভোগীরা।

প্রতিটি হলেই হল প্রশাসন আছে। দিনের পর দিন নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েও নির্যাতনকারীরা পার পেয়ে যান। কারণ, তাঁরা ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। আর তাই শত শত ঘটনা ঘটলেও কোনো বিচার নেই। হলগুলোয় আসন–বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনটি সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ শুনেছি, বিভিন্ন হলের বেশ কিছু কক্ষ সরকারি ছাত্রসংগঠনকে বরাদ্দ দিতে হয়।

এই যে অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া, এখান থেকেই শিক্ষার্থী নামধারী সন্ত্রাসীরা যেকোনো কাজ করার উৎসাহ পান। একপর্যায়ে এই উৎসাহ থেকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। আবার এসব নির্যাতনকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবার কোনো কারণ নেই। সারা দেশে যে অনিয়ম, নিপীড়ন, নির্যাতন চলছে; হলগুলোর শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা সেসব ঘটনারই ধারাবাহিকতামাত্র।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনোভাবেই এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু সুকৌশলে এসব ঘটনার দায় এড়াতে চান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা যত দায় এড়িয়ে চলবেন, তত এ–জাতীয় ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

হলগুলোয় আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি আগেও ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো এত প্রকট আকার কখনো ধারণ করেনি। এর একটা বড় কারণ, আগে হলগুলোয় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সহ-অবস্থান ছিল। বর্তমানে শুধু ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনটিই রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারছে। এর ফলে তাদের একক আধিপত্য তৈরি হয়েছে। এটি খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার, চার ঘণ্টা ধরে একজন ছাত্রীকে নিপীড়ন করা হলো কিন্তু হল প্রশাসন কিছু জানতে পারল না। দীর্ঘদিন ধরে হলের নানা কক্ষে এসব ঘটনা ঘটলেও হয়তো কোনো পরিত্রাণ হবে না ভেবে শিক্ষার্থীরা কারও কাছে অভিযোগ জানান না। অভিযোগ জানালেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পাবেন, সে আলামত আমরা দেখিনি। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি চেপে বসেছে। ভয়ের এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার একটিই উপায়, সেটি হলো অপরাধী অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়ন–নির্যাতনের ধারাবাহিকতা বজায় আছে। যাঁরা এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা কিন্তু কেউ আদর্শ লালন করে রাজনীতি করছেন না; বরং রাজনীতিকে তাঁরা ক্ষমতাচর্চার অংশ হিসেবেই নিয়েছেন। এই ক্ষমতাচর্চার অংশের মধ্যেই শারীরিক নিপীড়ন হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। এতে নিরঙ্কুশভাবে নৈরাজ্যকে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়। দেশের সব কটি ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন এই নৈরাজ্য–ব্যবস্থাকে জারি রেখেছে। এতে তারা সফল হয়েছে।

এসব নিপীড়ন–নির্যাতনের বিরুদ্ধে আরও জোরদার ভূমিকা রাখা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা দেখছি, অভিভাবকতুল্য শিক্ষকেরা এসব ব্যাপারে একধরনের নীরবতা পালন করেন। সন্ত্রাসীদের হাতে হেনস্তা অথবা নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে শিক্ষকেরা চুপ থাকেন। আবার দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে একদল শিক্ষক এসব বিষয়ে সমঝোতা করে মীমাংসার দিকে এগোন। ফলে অপরাধীরা সহজেই গুরুতর অন্যায় করার পরও পার পেয়ে যান। তাই এসব ঘটনার বিচার হতে হবে। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের লাগাম টানতে হবে। আমাদের দেশ অবকাঠামোগত উন্নয়নে বহু এগিয়ে গেছে। অথচ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারছি না। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার হোক, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটুক।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়