ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েমে সম্মতি উৎপাদন করেছেন বিশালসংখ্যক সাংবাদিক: প্রেস সচিব
আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনকে ‘ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী’ বলে বর্ণনা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েমে সম্মতি উৎপাদনের কাজ করেছেন বাংলাদেশের বিশালসংখ্যক সাংবাদিক। এটা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। গত ১৬ বছরে কার কী ভূমিকা ছিল, কে কীভাবে সাংবাদিকতা করেছেন, তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত গণমাধ্যম চাই’ প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এক আলোচনা সভায় শফিকুল আলম এ কথা বলেন। ‘জুলাই গণহত্যায় গণমাধ্যমের ভূমিকা: জবাবদিহি ও সংস্কার প্রস্তাব’ শিরোনামের এই সভায় তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, ‘গত ১৬ বছরে গণমাধ্যমের ভূমিকা কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিরোইক (বীরত্বপূর্ণ)। অনেক সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন। সত্য বলতে পিছপা হননি। সেই সব সাংবাদিককে আমি স্যালুট জানাই। জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে অকুতোভয় সাংবাদিকদের আমি স্যালুট জানাই। কিন্তু ১৬ বছরের যে ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী শাসন, এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে সম্মতি উৎপাদন করতে হয়। এই সম্মতি উৎপাদনের কাজ করেছেন বাংলাদেশের বিশালসংখ্যক সাংবাদিক। এটা নিয়ে আমাদের সিরিয়াস কাজ করতে হবে। বললেই কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়ায় না। গত ১৬ বছরে কার কী ভূমিকা ছিল, কে কীভাবে সাংবাদিকতাটা করেছে, তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার।’
প্রেস সচিব বলেন, ‘২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ৬-৭ জনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা কী ছিল? পরের দিনের প্রতিবেদনগুলো দেখবেন। এটা নিয়ে কি সিরিয়াস কোনো প্রতিবেদন করা হয়েছে যে ওই সহিংসতায় কার ভূমিকা ছিল? বিডিআর-পরবর্তী সাংবাদিকতা, ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল-পরবর্তী সাংবাদিকতা, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অনেকগুলো ছেলেমেয়ের নিখোঁজ হওয়া বিষয়ে সাংবাদিকতা—এগুলো দেখা উচিত। কোন সাংবাদিকের ভূমিকা কী ছিল, তা দেখা দরকার। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে গণমাধ্যমে কারা কারা জাস্টিফাই করেছে, ভয়াবহভাবে সমর্থন দিয়েছে, তা দেখা দরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেভাবে ফাঁসি দিয়েছে, এটা যে একটা দুর্বল আদালত, সেটা নিয়ে গণমাধ্যম একটা কথাও বলেনি। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চে অগ্নিসংযোগের কথা বলা হলো, সেটা কারা কীভাবে করল? সেই সময় সাংবাদিকতাটা কেমন ছিল? ওটার মাধ্যমে বিরোধী দলের রাজনীতিটাকে ডিলেজিটিমাইজ করা হয়েছিল। ওরা জঙ্গি, অগ্নিসন্ত্রাস করে, ওদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই—এই ন্যারেটিভটা মূলত ২০১৪-১৫ সালের। এটা আমাদের পর্যালোচনা করা উচিত। গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে কী ধরনের সাংবাদিকতা হয়েছে, তা আমাদের জানা উচিত। শাপলা চত্বরে হেফাজতের ওপর যে হত্যাকাণ্ড, সেটাও দেখা দরকার।’
যাঁরা সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাংবাদিকতা নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, সারা জীবন এটাকে ব্যবহার করা যাবে। এটা আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য হবে। সবাই জানতে পারবে, ফ্যাসিবাদী বয়ান কীভাবে তৈরি হয়েছে। অধিকার সংগঠন, আরএসএফ, সিপিডি, আন্তর্জাতিক সাংবাদিক অধিকার সংগঠনকে তিনি আহ্বান জানাবেন, তারা এসে খতিয়ে দেখুক, কী ধরনের সাংবাদিকতা হয়েছে। গণমাধ্যম নিয়ে তাদের বিবৃতিকে তাঁরা স্বাগত জানান। কিছু না পারলেও গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে সাংবাদিকতা হয়েছে, টিভিতে যেভাবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাসী বলা হয়েছে, সেগুলো জানানো। তাদের আহ্বান, তারা এসে খতিয়ে দেখুক, কী ধরনের সাংবাদিকতা হয়েছে, কীভাবে ফ্যাসিবাদী বয়ান তৈরি হয়েছে। তাঁরা তাদের কাজের প্রশংসা করেন। কিন্তু তাঁরা যদি এই কাজগুলো না করেন, তাহলে তাঁরা একধরনের ‘ওভারলুক’ করছে বলে তাঁরা মনে করবেন।
আলোচনায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেন প্রেস সচিব। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকে এ নিয়ে একটা প্রতিবেদনও করেনি। সম্পাদক পরিষদসহ অনেকে এর নিন্দাও জানাননি। এই ব্যর্থতাগুলো ছিল। গত প্রায় ১৬ বছরে অনেক ধরনের ফ্যাসিবাদী বয়ান তৈরি হয়েছে। মানুষের কণ্ঠকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কাউকে শিবির, কাউকে বিএনপি, কাউকে যা-তা ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, প্রতিটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে গবেষণার দাবি রাখে। কথ্য ইতিহাস প্রকল্প করা যায়। সেখানে সবাই এসে বলে যাবেন। সবকিছু লিপিবদ্ধ রাখতে হবে। এটা ইতিহাসের প্রতি দায়।
আওয়ামী লীগের ‘গণহত্যার’ বিচার না করতে পারলে দেশে ফ্যাসিবাদ কখনোই বন্ধ হবে না বলে মন্তব্য করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য সৈয়দ আবদাল আহমেদ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল। ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচনে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতা সম্পূর্ণ কবজা করার পর ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসেছিল। তিনি হিটলারকে অনুসরণ করা শুরু করেন। শেখ হাসিনা এমন অবস্থা সৃষ্টি করলেন যে গণমাধ্যম থাকবে, কিন্তু তারা ফ্যাসিবাদ ও আওয়ামী লীগের জয়গান গাইবে।
আমার দেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ বলেন, পত্রিকাটি সরকারের অপকর্ম ও মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিল। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ঝোঁক ছিল। শেখ হাসিনা দেখলেন যে এ ধরনের গণমাধ্যম রাখা যাবে না। পরে আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেওয়া হয়। একটা গোষ্ঠী তারা তৈরি করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনগুলোয় তাদের নিজস্ব সাংবাদিক ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। এমনকি প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সাংবাদিকদেরও সেখানে দাওয়াত দেওয়া হতো না। সমকালের প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের মতো একজন ব্যক্তিত্বকে তোষামোদি করতে দেখেছেন। সংবাদ সম্মেলনে সার্বক্ষণিক তোষামোদি দেখা গেছে। এই শ্রেণি ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে আমরা সংবাদকর্মীদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছি। গণমাধ্যমগুলোর ভেতরের অবস্থা ভিন্ন হলেও মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকেরা আমাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন।’
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক ও শিক্ষক মাহাবুব আলম। এতে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো বিদ্যমান সব নীতি-আইন থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা পরিমার্জনা করে একটি স্বাধীন গণমাধ্যম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। যেসব মালিক ও নির্বাহীরা গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করেছেন, তদন্তসাপেক্ষ তাঁদের বিচারের আওতায় এনে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ তৈরি করা। গণমাধ্যমের মালিকানা ও অর্থায়নের উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। যেকোনো সময় যেকোনো টেলিভিশন ও পত্রিকা সরকার বন্ধ করে দিতে পারার ভয়ংকর পদ্ধতি বা নীতি চিরতরে বন্ধ করা। সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন ও পেশাগত সুরক্ষার জন্য টেকসই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গড়তে একটি গণমাধ্যম কমিশন ও নীতিমালা প্রণয়ন। গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অভিন্ন ওয়েজ বোর্ড প্রণয়ন। অবিলম্বে নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন ও শ্রম আইন অনুযায়ী সংবাদকর্মীদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের ব্যবস্থা করা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাসহ সব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিচার নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের গুম, নির্যাতন ও হয়রানির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিতে কমিটি গঠন। একটি স্বতন্ত্র মিডিয়া কমিশন গঠন, যা সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই মিডিয়ার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয় করবে; পাশাপাশি সাংবাদিকদের চাকরির সুরক্ষা, বেতনসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করবে।
‘ফ্যাসিবাদমুক্ত গণমাধ্যম চাই’ প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক সাংবাদিক জয়নাল আবেদিন শিশির আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন। প্ল্যাটফর্মটির মুখপাত্র প্লাবন তারিকের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে সাংবাদিক এস এম রাশেদুল ইসলাম, আব্বাস উদ্দিন নয়ন ও ফয়েজ আহমেদ, আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি তৌহিদুর রহমান আউয়াল, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।