আমাদের ঈদ বলে কিছুই নেই: জিম্মি নাবিকের মা

সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি নাবিক আইনুল হকের মা লুৎফে আরা বেগম ছেলের দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের আসকারদীঘিপাড় এলাকার বাসা থেকে তোলাছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রামের আসকারদীঘিপাড়ে ছোট্ট বাসাটিতে ঢুকেই দেখা গেল ফ্রেমে বাঁধা আইনুল হকের ছবি। সন্তানের ছবির পাশেই সোফায় বসে মা লুৎফে আরা বেগম জানতে চাইলেন, ‘আমার ছেলে কখন ফিরে আসবে? কখন মুক্তি পাবে দস্যুদের হাত থেকে?’

আইনুল হক সোমালিয়ায় জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিক। গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার দস্যুরা ভারত মহাসাগর থেকে জাহাজটি ছিনতাই করে। তারা আইনুল হকসহ জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করেছে। আজ মঙ্গলবার জিম্মিদশার ২৭ দিন চলছে। এখনো নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।

ছেলের চিন্তায় মায়ের ঘুম আসে না। ঘুমানোর জন্য প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ সেবন করছেন বলে জানালেন তিনি। লুৎফে আরা বেগম তিন দিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসক দেখে পরামর্শ দেন, দুশ্চিন্তা করা যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ কীভাবে মানবেন মা?

গতকাল সোমবার আসকারদীঘিপাড়ের ওই বাসায় লুৎফে আরা বেগমের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ছেলেকে নিয়ে তিনি বলতে থাকেন, গত ঈদে মায়ের জন্য শাড়ি এনেছিলেন আইনুল। পছন্দ হয়েছে বলতেই খুব খুশি হয়েছিলেন ছেলে। এখন ছেলে দস্যুদের হাতে বন্দী। এবার ঈদ উপলক্ষে পরিবারের কেউ নতুন পোশাক কেনেননি বলে জানান তিনি। এই মা আরও বলেন, ‘আমাদের ঈদ বলে তো কিছুই নেই। ঈদের দিনটা যত তাড়াতাড়ি যাবে, সেটাই চিন্তা করি।’

লুৎফে আরা বেগম ছোট ছেলেকে নিয়ে এই বাসায় থাকেন। ছোট ছেলে মাইনুল হক এবার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। ২০০১ সালে করোনার সময় আইনুল হকের বাবা মারা যান। সে সময় আইনুল ছিলেন জাহাজে। বাবার মৃত্যুর কথা শুনে ছুটি নিয়ে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে আসেন।

জাহাজি জীবনে নাবিকদের ঈদ কোথায় কাটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়তো গভীর সাগরে চলন্ত জাহাজে কিংবা কোনো বন্দরে নোঙর করা জাহাজে। তবু বাবা মারা যাওয়ার পর অন্তত প্রতিবার ঈদের সময় মায়ের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন আইনুল হক। গতবারও ঈদের সময় ছিলেন মায়ের পাশে। এবারও বলেছিলেন, ঈদের সময় মায়ের পাশে থাকার চেষ্টা করবেন। দস্যুদের হাতে পড়ে সেটি আর হয়নি।

সরকারি নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৬ সালে কবির গ্রুপের জাহাজে যোগ দেন আইনুল হক। ৯ বছরের জাহাজি জীবনে এবারই প্রথম জিম্মিদশার পড়েছেন আইনুল হক। জিম্মি হওয়ার পর এখন সপ্তাহে একবার বাড়িতে যোগাযোগের সুযোগ দেয় দস্যুরা। তবু মায়ের মান মানছে না।

মা বলেন, ‘ছেলে অস্ত্রধারীদের সঙ্গে আছে—ভাবতেও ভয় লাগে। আমাদের সন্তানেরা মায়ের বুকে ফিরে আসুক। দিনগুলো কষ্টে যাচ্ছে।’

আইনুল হকের মতো একই জাহাজে জিম্মি রয়েছেন নাবিক মোহাম্মদ নুরউদ্দিন। জিম্মি হওয়ার পর থেকে দুশ্চিন্তা কাটছে না তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের। একমাত্র ছেলে ফারদিন নুরের বয়স আড়াই বছর। একটু একটু কথা বলতে পারলেও এখনো বোঝার বয়স হয়নি। ফারদিনের মায়ের মুঠোফোনের রিং বেজে উঠলে শুধু ‘পাপা কই, পাপা কই’ বলে বাবার খোঁজ জানতে চায় সে।

জান্নাতুল ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত তিন বছর রোজার ঈদের সময় নুরউদ্দিন ছিল জাহাজে। জাহাজেই সহকর্মীদের সঙ্গে ঈদের দিন কেটেছে। গত নভেম্বরে এই জাহাজে যোগদানের সময় অনুরোধ করেছিলাম, এবার যেন ঈদের দিন ছেলের সঙ্গে থাকে। রোজার শেষ দিকে আসবে বলে কথাও দিয়েছিল। এরপর তো ২৭ দিন ধরে কষ্টের দিন গুনছি।’

আইনুল হক, নুরউদ্দিনের মতো ২৩ নাবিকের এবার ঈদ কাটবে দস্যুদের সঙ্গে। নাবিকেরা কখন মুক্তি পাবেন, তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ।

জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দস্যুদের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি হচ্ছে। নাবিকদের দ্রুত ফিরিয়ে আনতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’