দেশে দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী, ঢাকা আর্ট সামিট, ছবি মেলার মতো বড় আকারের শিল্পকলার প্রদর্শনী হচ্ছে। এই আয়োজনগুলোর তাৎপর্য জনজীবনে কতটুক? জনরুচি গড়তে কতখানি প্রভাব রাখছে? শিল্পকলার চর্চা তথা শিল্পীদের ক্ষেত্রেই বা এসবের কার্যকর ভূমিকা কেমন—এসব নিয়েই ছিল বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা। শিল্পী ও কলাবিদেরা বললেন, বিপুল সরকারি অর্থ খরচ করে যে এশিয়ান দ্বিবার্ষিক এখন হচ্ছে, তার মান পড়ে গেছে। এখন মানহীন আড়ম্বরসর্বস্ব আয়োজনে পর্যবসিত হয়েছে। এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।

শনিবার সন্ধ্যায় ‘প্রদর্শনীর পঞ্চতন্ত্র: স্মরণীয় ও অবিস্মরণীয় বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনায় এমন মূল্যায়ন উঠে এসেছে। শিল্পী ও শিল্পসমালোচকদের অংশগ্রহণে রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের ‘উত্তরসূরী: নুরজাহান-সারওয়ার মুরশিদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ মিলনায়তনে এই আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন উত্তরসূরীর প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ। তিনি বলেন, ‘গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক আমাদের সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ ও নুরজাহান মুরশিদ ছিলেন এই দশকের চিন্তা, সৃজন, মননের অন্যতম প্রতিনিধি। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁদের মূল্যবোধ, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পৌঁছে দিতেই কাজ করবে উত্তরসূরী।

মূল প্রবন্ধ পড়েন উত্তরসূরীর পরিচালক মোস্তফা জামান। প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী ও গবেষক তাহমিদ জামি। পরে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক শিল্পী রশীদ আমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাসিমুল খবির এবং শিল্পী, সমালোচক ও সংগঠক জাভেদ জলিল, জাফর ইকবাল, আবু নাসের প্রমুখ। শেষে ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, যেকোনো প্রদর্শনী দর্শকের সঙ্গে শিল্পের যোগাযোগ ঘটায়। তবে বর্তমান বিশ্বে দ্বিবার্ষিকের মতো এমন বড় আয়োজনগুলোর সঙ্গে পুঁজির প্রভাবের বিষয়টি যুক্ত। যদিও এসব আয়োজন অবাণিজ্যিক বলা হচ্ছে, তবু এর একটি বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক রয়েছে। তিনি আলোচনায় বলেন, এই প্রদর্শনীগুলো শিল্পের মূল ধারার সঙ্গে বিভিন্ন উপধারা, আলোকচিত্র, সিনেমা, পারফরমেন্স মিলিয়ে একটি বিপুল বৈচিত্র্যময় সম্ভার জনসম্মুখে উপস্থাপন করে। এর মিথস্ক্রিয়া, নতুনত্ব, পরিসর, পরিপ্রেক্ষিত এবং স্থানিক গুরুত্বের বিষয়গুলো বুঝবার ও ভাববার উদ্দীপনা জাগায়। এ ধরনের প্রদর্শনীর বিবর্তন এবং এতে ক্রমশ অপরিহার্য হয়ে ওঠা কিউরেটরের ভূমিকার বিষয়গুলোও তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে।

এশীয় দ্বিবার্ষিক বা ঢাকা আর্ট সামিটের মতো বড় প্রদর্শনীর লুভা নাহিদ চৌধুরী এসব বড় আয়োজনের ভেতর দিয়ে প্রকৃত পক্ষে জনরুচি তৈরি করা যাচ্ছে কি না বা জনমানসে তার প্রভাব কতটা, এই প্রশ্ন রাখেন। তিনি বলেন, এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের বিষয়ে আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারি না। আবার অনেক সময় এমন বড় আয়োজনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা থাকে। তবে সেখানেও প্রশ্ন থাকে প্রকৃতই কী প্রান্তিক জনগণের যা মনের কথা তার যথার্থ প্রতিফলন কি সেখানে থাকে? এই বিষয়গুলোর মূল্যায়ন হওয়া দরকার। যে উদ্দেশ্যে আয়োজনগুলো হয় তা লক্ষ্য অর্জন করতে পরছে কী না তা নিয়ে যাচাই–বাছাই ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

তাহমিদ জামি তাঁর আলোচনায় আমাদের দেশে প্রদর্শনীর ইতিহাস, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আধুনিক রীতির গ্যালারিভিত্তিক প্রদর্শনীর প্রচলন ও তার বিবর্তনের ধারায় আধুনিক শিল্পকলার চর্চায় প্রদর্শনীর ভূমিকার ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ তুলে ধরেন।

বক্তারা বলেন, শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর মান ২০১০ সালের পর থেকে ক্রমাগত নিম্নগামী হয়েছে। এখানে একই স্থানে ঢাকা আর্ট সামিট ও ছবিমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এশিয়ান বিয়েনাল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে এই দুটি আয়োজনের বাহ্যিক আড়ম্বরে গা ভাসিয়েছে। বিদেশের কোনো বড় মাপের শিল্পী দ্বিবার্ষিকে আসছেন না। জনগণের অর্থ খরচ করে কেবল আড়ম্বর আর প্রতিনিধিত্বকারী দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি দেখিয়ে যে আয়োজন হচ্ছে, সে বিষয়ে শিল্পী, সমালোচক, গণমাধ্যম সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। এটা দেশের চারুশিল্পের বিকাশ এবং এশিয়ান দ্বিবার্ষিকের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই অতি প্রয়োজন।