তারুণ্যের জয় মানে দেশের জয়
দেশের রাজপথে গত বছর তরুণেরা ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত তৈরি করেছিলেন, গণ-অভ্যুত্থান। চাকরিতে কোটা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনটা শুরু করেছিলেন জেন-জিরা, তা ক্রমে এক সামাজিক জাগরণে রূপ নিয়েছিল।
লাখো মানুষ সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে। কেউ যদি ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটি উদ্যোগ শুরু করেন, তার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার টাকা চলে যায় ঘুষ আর অনিয়মে। অথচ এই টাকাটা একজন তরুণের তিন মাসের খরচ। ওই সময় তিনি কোডিং করে পৃথিবীর সেরা অ্যাপগুলোর একটি বানাতে পারতেন। এই অর্থ আধুনিক প্রজন্মের কাছে ‘ব্লাড মানি’। এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সেদিন তরুণদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে এসেছিল সাধারণ মানুষ।
এমন বৈষম্য কেবল আর্থিক নয়-বৈষম্য আছে শিক্ষায়, সরকারি নীতিমালায়, এমনকি স্বপ্ন দেখায়ও। আর এই বৈষম্যের আমি ও আমার প্রজন্ম প্রতিদিন লড়াই করে যাচ্ছি।
রাস্তায় স্বপ্নের শুরু
২০০৯ সাল। তখন আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ক্লাসে ইলেকট্রিক মোটর শেখানো হচ্ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে শিখি। প্রতিদিন উত্তরার বাসা থেকে মহাখালীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হতো। পথে মোটর মেরামতের দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে দেখতাম, কীভাবে গাড়ির যন্ত্রপাতি খুলে আবার জোড়া লাগানো হয়। তখন থেকেই নিজের হাতে গাড়ি বানানোর স্বপ্ন জাগে মনে।
পুলিশ স্টেশনের সামনে যেসব পরিত্যক্ত গাড়ি পড়ে থাকে, সেখান থেকে একটি নিখরচায় পাওয়া গেলে তাতে হাইটর্ক মোটর লাগিয়ে একটি ইলেকট্রিক গাড়ি বানানো যেতে পারে—মাথার ভেতর এমন ভাবনাই ছিল। তখন টেসলা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।
পরে এমন একটি গাড়ির ডিজাইন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোসাদ্দেক স্যারের হাতে দিই। তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন। পরে ওই ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে একটি গাড়ি বানানো হয়। এরপর ক্রেডিট ট্রান্সফার করে পড়তে যাই যুক্তরাষ্ট্রে, মন্টানা ইউনিভার্সিটিতে। অর্ধেক স্কলারশিপ পেলেও বাকি খরচ জোগাতাম পুরোনো গাড়ি কিনে মেরামতের পর তা বিক্রি করে। পাশাপাশি দু-তিনটি ছোট চাকরিও করেছি।
তবে সব সময় একটাই চিন্তা ঘুরত মাথায়—আমি কবে দেশে ফিরব! কারণ, বাংলাদেশের বৃষ্টি, সবুজ প্রকৃতি, মাটির গন্ধ আর নিজের ভাষায় কথা বলার আনন্দ ও শান্তি পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
‘পালকি’র গল্প
শেষমেশ পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালে দেশে ফিরলাম। স্বপ্ন ছিল নিজের একটি গাড়ি কোম্পানি গড়ব। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব কিছুই জানা নেই। তাই সময় লেগে গেল। বহু বাধা পেরিয়ে ২০২২ সালের মার্চে ‘পালকি মোটরস’ যাত্রা শুরু করল। আমাদের কারখানা ঢাকার উত্তর বাড্ডায় সাতারকুল সড়কে।
পালকি মোটরসের আইডিয়াটা এসেছিল মেডিটেশনের সময়, সঙ্গে ছিল নেপোলিয়ন হিলের থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ বইটি। বইয়ের পরামর্শমতো প্রথমে নিজের স্বপ্নগুলো লিখে ফেলি। কী করতে চাই, জীবনে কী অর্জন করতে চাই—সব। যেমন বাংলার এন্ডেমিক গাছপালা ও প্রাণী সংরক্ষণে বন তৈরি করব, যা মহাকাশ থেকেও দেখা যাবে।
ওয়েটেড ম্যাট্রিক্স ব্যবহার করে কোন আইডিয়ার বাজার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তার বিশ্লেষণ করি। এতে পালকি সবার ওপরে থাকে। তারপর শুরু হয় মনের প্রোগ্রামিং। প্রতিদিন আমার স্বপ্নকে কল্পনায় দেখি। অনুভব করি আমার ফ্যাক্টরি, কর্মচারী, গাড়ি—সবকিছু।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। গাড়ির যন্ত্রপাতি আনতে লাগবে সাড়ে সাত লাখ টাকা, অথচ আমার তিনটা ক্রেডিট কার্ডেরই সীমা শেষ। এই পরিস্থিতিতে একটা ফ্ল্যাট বিক্রি করে ঋণ শোধ করার পর হাতে থাকল মাত্র ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মামার কাছ থেকে ধার করলাম ৫০ হাজার। সেই টাকা দিয়েই যন্ত্রপাতি অর্ডার করে এনে কাজ শুরু করা হলো।
অবশেষে আমরা বানালাম নিজেদের ডিজাইনে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বৈদ্যুতিক গাড়ি। যার প্রতিটি ইঞ্চি তৈরি হয়েছে এই দেশের তরুণদের হাতে।
স্বপ্নের পথে অবিচল
এই পথচলায় কত ব্যঙ্গ ও কত তির্যক মন্তব্য শুনেছি। অনেক কষ্ট সয়েছি। কেউ বলেছে, এসব করে জীবন নষ্ট করে ফেলছি। কিন্তু আমার সামনে একটাই প্রশ্ন ছিল, স্বপ্ন কি কেবল ধনীদের জন্য? গাড়ি কি কেবল উন্নত দেশগুলোই বানাবে?
আমরা এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। আমরা আমাদের স্বপ্নের পথেই থেকেছি। ২০২২ সাল থেকে গবেষণা করে তৈরি করেছি ইলেকট্রিক গাড়ি, পিকআপ। আমাদের গাড়িগুলো সব মিলিয়ে প্রায় ১৮ লাখ কিলোমিটার চলেছে।
হাজারো মানুষ এই গাড়ির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষই আমাদের প্রধান গ্রাহক। তাঁরা আমাদের গাড়ি কিনে চালিয়ে আদতে শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধপথে ছুটছেন।
আমাদের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি এসেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ‘জায়েদ সাসটেইনেবিলিটি প্রাইজ ২০২৫’-এ ১৫১টি দেশকে পেছনে ফেলে ‘এনার্জি’ বিভাগে জয়ী হয়েছি। পেয়েছি ১ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার। সিঙ্গাপুরের ‘এক্সিলারেটিং এশিয়া’ প্রোগ্রাম থেকে তহবিল পেয়েছি।
এটা শুধু আমার একার সংগ্রাম নয়। এটি হাজারো তরুণের গল্প, যাঁরা প্রতিদিন আর্থিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেদের জন্য, দেশের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করছেন। এই গল্প সেই তরুণ-তরুণীর, যাঁরা বৈষম্যের মধ্যেও হাল ছাড়েন না।
বৈষম্যের দেয়াল ভাঙার লড়াই
সরকার সম্প্রতি ‘ইলেকট্রিক ভেহিকেল নীতিমালা ২০২৫’ প্রণয়ন করেছে। এই নীতিমালা কাগজে-কলমে বিপ্লবী মনে হলেও বাস্তবে এটি বড় কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করছে।
সিবিইউ (সম্পূর্ণ আমদানি করা) গাড়ির জন্য আমদানি শুল্ক মাত্র ৩০ শতাংশ, আর সিকেডির (স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল করা) জন্য শুল্ক ১৫ শতাংশ, যা সিকেডি প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
দেশীয় নির্মাতাদের ওপর চাপানো হয়েছে কড়াকড়ি নিয়ম। কাঁচামালে ১ শতাংশ শুল্ক পেতে হলে কোটি টাকার যন্ত্রপাতির বাধ্যবাধকতা, পরিদর্শনের নামে ঘুষের চাপ—সব মিলিয়ে ছোট উদ্যোক্তারা যেন কখনোই বিদেশি ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে না পারে। যেন তারা বলতে না পারে, ‘আমরাও গাড়ি তৈরি করি।’
আমরা চাই সরকার এই বৈষম্য দূর করুক, বিআরটিএতে ঘুষ এবং দুর্নীতি বন্ধ হোক। এসএমই উৎপাদন খাতে কাঁচামালের ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক চালু হোক। দেশের মাটিতে উদ্ভাবিত গাড়িগুলোর রাস্তায় পরীক্ষার অনুমতি সহজ করা হোক। গ্রিন ফাইন্যান্স সবার নাগালে আসুক এবং ৫০০ কোটি টাকার স্টার্টআপ ফান্ড যেন সহজ শর্তে দেশি ও বিদেশি যোগ্য ফান্ড ম্যানেজারদের মাধ্যমে সুষম ও বৈষম্যহীনভাবে বণ্টন করা হয়।
এই নীতিগত বৈষম্য দূর করা না গেলে পালকি মোটরসের মতো হাজারো সম্ভাবনা হারিয়ে যাবে। তাই এখনই এমন একটি পরিবেশ দরকার, যেখানে তরুণেরা উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে ভয় পাবেন না, বরং রাষ্ট্র তাঁদের পাশে দাঁড়াবে।
শিক্ষায় চাই বাস্তব জ্ঞান
বলা হয়, বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর গড় মান আন্তর্জাতিক মানের অষ্টম শ্রেণির সমান। প্রতিবছর লাখ লাখ স্নাতক বের হন, কিন্তু বাস্তব দক্ষতার ঘাটতিতে চাকরি পান না। চাকরির সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, তাঁরা সমস্যা সমাধানে দুর্বল, আত্মনির্ভরশীল নন। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থা তাঁদের বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করেনি।
এদিকে সেরা শিক্ষার্থীরাও বিসিএস পরীক্ষার জন্য দুই বছর প্রস্তুতি নিয়ে নিজেদের দক্ষতা হারিয়ে ফেলেন। তাঁদের অনেকেই বিসিএসে সফল হন না, আবার চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন।
এই বাস্তবতা বদলাতে হলে শিক্ষা খাতে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে যৌথ গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে। যাতে কোম্পানিগুলো গবেষণায় অর্থায়ন করে এবং অধ্যাপকেরা বেশিসংখ্যক গবেষণা সহকারী নিয়োগ দিতে পারেন। এতে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিখতে পারবেন, প্রকৃতপক্ষে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হতে পারবেন। শুধু সার্টিফিকেট নয়, বাস্তব জ্ঞানই পারে তরুণদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।
তরুণদের জয় মানে দেশের জয়
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন আর শুধু স্বপ্ন দেখে না, তারা সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চায় এবং সে জন্য সংগ্রাম করতেও প্রস্তুত। প্রতিটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, প্রতিটি অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হচ্ছে। প্রযুক্তি, শিল্প, শিক্ষা—সবখানে প্রমাণ করছে সুযোগ পেলে তারাও বিশ্বমানের কিছু তৈরি করতে পারে।
কিন্তু সেই সুযোগ এখনো সবার জন্য সমান নয়। বৈষম্য যখন একজন স্বপ্নবান তরুণকে থামিয়ে দেয়, তখন সেটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় ক্ষতি। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণদের ওপর। তাদের স্বপ্ন দেখার অধিকার, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা চাই। সে জন্য রাষ্ট্রকে তরুণের পাশে থাকতেই হবে। নীতিমালা হতে হবে তরুণবান্ধব।
তাই সরকার, নীতিনির্ধারক, শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজ—সবার উচিত তরুণদের পাশে দাঁড়ানো। কারণ, তারুণ্যের জয় মানেই দেশের জয়।
মোস্তফা আল মমিন. প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পালকি মোটরস লিমিটেড